ষাট দশক তো বটেই, সত্তুর দশকেও বাংলাদেশের মফস্বল শহরগুলোতে ইটের বৃহদাকার দালান খুব একটা গড়ে ওঠেনি। ছিল অল্প কিছু একতলা এবং কালেভদ্রে দোতলা দালান। কিছু জেলা শহরে ইংরেজদের তৈরি স্কুল-কলেজ, সরকারি ভবন, এবং কোথাও কোথাও জমিদার বাড়ি। ঢাকায়ও ইমারত ছিল কম। সেসময়টায় প্রায় সব শহরগুলোতে সমস্ত বাড়িঘর আর স্থাপনা ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে থাকতো সিনেমা হলগুলো। দর্শনীয় একটি অট্টালিকা, বিশাল ব্যানারে নায়িকার লাস্যময়ী ছবি— শহরের অনেক পুরুষের অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষা সেখানে আরাম পেত। কখনোবা নায়ক নায়িকার রোমান্টিক মুহূর্ত সে ব্যানারে আমাদের অচয়িত প্রেমের মূর্ত প্রতিক হয়ে শহরের যুবক যুবতীদের বাসনাকে জ্বলজ্বল করে ধরে রাখতো। ব্যানারে নায়কের প্রতিবাদ সমষ্টির বাস্তবে নিজে করতে না পারার গ্লানিকে ভুলিয়ে দিত।
ছোট বড় সব শহরে সিনেমা হল ঘিরে একটা জমজমাট জনসমাগম ছিল। হলগুলোর চমৎকার নাম—ইন্দ্রপুরি, অলকা, উজালা, ছায়াবানি, চিত্রলেখা ইত্যাদি। নামের ভেতর আমাদের মিথের স্বপ্নস্পর্শ, আবার কখনও নামই বলছে চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সিনেমার কী পরিচয়। বিকেলে সিনেমাহলের সামনে ভিড় হতো। সবাই যে সিনেমা দেখতে আসতো তা নয়, কিন্তু এটা ছিল পাবলিক স্পেস। দিনের কাজ শেষে লোকজন আসতো আড্ডা দিতে। বাদাম-বুট এবং সিদ্ধ ডিম নিয়ে বসতো ক্ষুদে-বাজারিরা। অধিকাংশ হলেই বিকেল থেকে মাইকে গান বাজত, চালু সব বাংলা ও হিন্দি গান। হয়তো নাগিন বা আওয়ারা সিনেমার গান কিংবা কলকাতার পুজোর হিট গান। আড্ডায় কেউ কেউ ঠোঁট মেলাতো “ছাইয়া দিলমে আনারে”, “মধুমালতি কে ডাকে আমায়” এরকম সব মাইকে বাজানো গানের সাথে।
সাধারণত প্রতিদিন দুটো শো থাকতো, সন্ধ্যে ৬টা থেকে রাত ৯টা এবং রাত ৯টা থেকে ১২টা, সন্ধ্যের শো এবং নাইট শো। কোন কোন হলে প্রতিদিন ম্যাটিনি শো দুপুরে। সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রবিবার, সেদিন বিকেলে শো থাকতো। কোন কোন হলে রবিবার সকালে ইংরেজি সিনেমা দেখানো হত। মূলত হলিউডের সিনেমা হলেও কালেভদ্রে ইতালিয়ান ও জাপানি ও অন্যান্য দেশের সিনেমাও প্রদর্শিত হত মর্নিং শোতে। শহরের তরুণরা ভিড় করতো মর্নিং শোতে। কেউকেউ বলতো ন্যাংটা শো- বাংলা উর্দু ও হিন্দি সিনেমার বিপরীতে অনেক খোলামেলা বলে।
টিকিট কেটে হুড়মুড় করে হলে ঢুকতাম। বাতি নিভে যেত, নিকষ আঁধারের ভেতর পর্দায় একটি জগত জেগে উঠতো, যেন ম্যাজিক। আমরা সব ভুলে সেই জগতে ডুবে যেতাম, চেতনার গভীরে ধাক্কা পেতাম, মগ্নতার ভেতর থেকে একটা শিষ উঠে আসতো। ইন্দ্রিয় ও কল্পনা দুটোতেই সিনেমা ধাক্কা দিত।
ইন্টারমিশনে ১০ মিনিটের বিরতি। ছেলেরা ধাক্কাধাক্কি করে প্রক্ষালনে যেত দ্রুত হালকা হয়ে আসতে। এক দেড় ঘণ্টা নিস্পলক মনোযোগে সিনেমা দেখে অনেকেরই তলপেটে জল জমে যেত। সেসময় কেউ খাচ্ছে চানাচুর, কেউ ফানটা, পটেটো চিপস এসেছে সত্তুরের মাঝামাঝি। বিরতি ফুরোলেই হুড়মুড় করে পুরুষ দর্শকরা যারা বাইরে সিগারেট ফুঁকছিল হলে ফিরে আসতো, ততক্ষণে ভেতরে আঁধার, পর্দায় সিনেমার জগত। অন্ধকারে কেউ কেউ হোঁচট খেয়ে পড়তো। বকাঝকা হতো কারও সামনে দিয়ে হেঁটে নিজের সিটে ফিরে আসার সময়। কেউই চাইত না এক সেকেন্ডের জন্যও পর্দার দৃশ্য মিস করতে। যে ছেলেটি ফানটা বিক্রি করেছে কিন্তু টাকা নেয়নি, সে আঁধারের ভেতরই ক্রেতাকে খুঁজে নিয়ে দাম নিয়ে যেত, কাউকে বিরক্ত না করেই।
দৈনিক পত্রিকার এক পৃষ্ঠা জুড়ে থাকতো সিনেমার বিজ্ঞাপন। রেডিওতেও বিজ্ঞাপন, বিশেষ করে দুপুরের বিজ্ঞাপন-তরঙ্গ অনুষ্ঠানে। সত্তুরের মাঝামাঝি বিজ্ঞাপন তরঙ্গে চলতি সিনেমা ১৫ মিনিটের স্লট কিনে নিত। জনপ্রিয় গানের ফাঁকে ফাঁকে দু’মিনিটের অডিও টিজার—গল্পের ইশারা ও সিনেমাটির গান নিয়ে নাটকীয় বিজ্ঞাপন। টেলিভিশন সেকালে পাড়ায় একটি বা দুটি থাকতো, গৃহস্থালি হয়ে ওঠেনি তখনও। অল্প কিছু সিনেমার টেলিভিশন বিজ্ঞাপন প্রচারণা শুরু হয় ৮০’র দশকে।
মফস্বল শহরে দুপুরটা ছিল অন্যরকম নির্জনতার পোশাকে ঢাকা। গৃহিণী রান্নাবান্না শেষ করে স্নান করে স্নিগ্ধ ক্লান্ত। অফিসের কেরানি ও কর্তা এবং দোকানি বাড়ি ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়েছে, মুখে পান। রাস্তায় একটি দুটি রিক্সা, অনেক বিরতিতে একটু টুংটাং। ঠিক সেসময় পারার ছোট রাস্তা দিয়ে একটা রিক্সার মাইকে বাজছে শহরের কোন সিনেমা হলের এ সপ্তাহ’র সিনেমার গান। মাঝে মাঝে একটি পুরুষ কণ্ঠ ভারিক্কি গলায় বলছে, অলকায় চলিতেছে কবরী ফারুক অভিনীত খান আতার ‘সুজন সখি’। তারপরেই গান, “সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলায় নেব সখি তোমার কানের সোনা, সখি গো, আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি, তোমার কাছে পয়সা নিব না”। ভাত ঘুমে চোখ বন্ধ হতে হতে পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় পরশু ৬টার শোটে ‘সুজন সখি’ দেখতে যাবে।
সিনেমা সেকালে গোটা দেশকে একত্রিত করতো। হিট সিনেমা নিয়ে আলোচনা মেয়েদের স্কুলে, ছেলেদের আড্ডায়। সিনেমা সাপ্তাহিকগুলো আলোচনা উসকে দিত। চিত্রালি ও পূর্বাণী ছিল জনপ্রিয় সিনেসাপ্তাহিক, পাতায় পাতায় সিনেমার খবর। নায়ক নায়িকাদের নিয়ে গুঞ্জন, এবং সিনেমার সমালোচনা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাঠকের চিঠিপত্র ছাপা হত সিনেমা পত্রিকায়। এসব পত্রিকায় প্রকাশিত নায়ক নায়িকার রঙিন ছবি শহরের চায়ের দোকানের দেয়ালে সাঁটা হত। চা সিঙ্গারা খেতে খেতে লোকজন সিনেমা নিয়ে আলাপ করত। গুঞ্জনের কলকাকলিতে সিনেমা—আলোচনা তারকাদের নিয়ে, কারও পছন্দ ববিতা তো অন্য কারও কবরী। এদেশে সিনেমায় রাজ্জাক-কবরী জুটিকে কেউ অতিক্রম করতে পারেনি, আজও না। ক্লাস নাইন-টেন বা কলেজে পড়ুয়া ছেলেরা রাজ্জাকের মতো চুলের স্টাইল করতে সেলুনে যেত। মেয়েরা চেষ্টা করতো কবরীর মিষ্টি হাসি রপ্ত করতে। ব্যাপারটা এতোটাই চর্চিত ছিল যে, সেকালে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলতো, ‘রাজ্জাক রাজ্জাক ভাব, কবরীর অভাব’।
ষাটের দশকে মুখে মুখে ফিরতো, “মা আমার মধুবালা, অমৃত সুচিত্রা খালা, বাবা আমার শেরেগুল, সাবিহা আমার প্রাণের ফুল”। পাকিস্তান ভারতের সিনেমা তারকাদের নিয়ে সেকালের মানুষের একটি জীবনবোধ তৈরি হয়েছিল। নইলে কি আর এরকম ছড়া গাঁথে মানুষ!
মনে আছে ১৯৬৯-এ রাঙ্গামাটিতে পায়েল ছবির শুটিং-এ রাজ্জাক বুকে আঘাত পায়। মুহূর্তেই সমস্ত শহর মুষড়ে পড়ে। শহরের হৃদপিণ্ডের গতি যেন থেমে গেলো। সবার প্রার্থনায় রাজ্জাক। গ্রামীণ বাংলাদেশে শহুরে জীবন একটু একটু করে উদ্বোধিত হচ্ছে, মানুষের রোমান্টিকতা ও আবেগে পরিবর্তন আসছে। সমাজের এরকম অচলায়তন ভাঙার সময় সিনেমার তারকাদের ভেতর মানুষ না হতে পারা নিজেকে দেখতো, তারকাদের তাঁরা ভালোবাসতো। বাইরে যাই হোক, কল্পলোকে সিনেমা ও জীবনের দূরত্ব ছিল না। সেকালে জীবনটা ছিল সিনেমাময়।
পরিবারের চিত্তবিনোদনের প্রধানতম মাধ্যম সিনেমা, গণআলোচনা ও জীবনযাপনে সিনেমা। রাজধানি ঢাকায় বেড়াতে আসলে সিনেমা না দেখলেই নয়। ঈদের দিনেও সিনেমা হলে ভিড়। গ্রামের লোক কাছাকাছি শহরে আসতো শুধুই সিনেমা দেখতে। ষাট দশকে ছাত্ররা অর্ধেক দামে সিনেমার টিকিট কাটতো, এবং জাতীয় দিবসগুলোতে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখানো হতো। রাস্তাঘাট ছিল না; লোকজন তিন ঘণ্টা হেঁটে আড়াই ঘণ্টার সিনেমা দেখে আবারও তিন ঘণ্টা হেঁটে বাড়ি ফিরত। গ্রামের আইলে অন্ধকারের স্তূপ, দূর আকাশে ধ্রুব তাঁরা মিটিমিটি জ্বলছে, সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পথে লোকটি মনেমনে তখনও আলোআঁধারির সিনেমা হলে।
সিনেমা আসলেই ছিল স্বপ্ন দেখার মত—অন্ধকার ফুঁড়ে আলো, যেন ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত এক জগত, যার শুরু এবং থামিয়ে দেয়া আমার হাতে নয়, সামনে পেছনে নেয়া যাবে না। অন্য কেউ সে জগতকে আমার জন্য দৃশ্যময় করে। আঁধারের বুক চিড়ে জাগ্রত হয় এক জগত যা আমি দর্শন করি ঈশ্বরের মত নিজেকে সকলের কাছে অদেখা রেখে।
‘রুপবান’ মুক্তি পেলে প্রকৃত অর্থে এদেশে সিনেমা-সংস্কৃতির শুরু। এর আগে সিনেমা শহর অতিক্রম করে গ্রামে যেতে পারেনি। বৃহদাংশ জনগণ ভাবতো সিনেমা ধর্মসম্মত নয়, এখানে চলমান মূর্তি দেখান হয়। যাত্রা দেখতে লোকজনের কোন সামাজিক ও মনোজাগতিক বাধা ছিল না। গানের পর গান নিয়ে রুপবান মুক্তি পেলে, লোকজন রুপবান-কে ভাবলো যাত্রারই সম্প্রসারিত রূপ। আলমগীর কবিরের অনুসন্ধান তাই বলে। সেই থেকে সিনেমাকে ঘিরে একটা আকর্ষণ তৈরি হল, সিনেমা দেখা অনুমোদিত হল আমাদের অনুশাসনে। সহসাই যোগাযোগ ও বিনোদনের এ প্রযুক্তিটি আমাদের মন ও মানসকে একটা গড়ন দিল। সিনেমা সংস্কৃতির শক্তিশালী উপাদান হয়ে সমাজে ও দেশে একটা ডিসকোর্স তৈরি করার মতো বলিষ্ঠ পাটাতন পেল। আমাদের জীবন হল সিনেমাময়।
এই রূপান্তরটি দ্রুত ঘটলেও, পরিবর্তনটি ছিল বৈপ্লবিক। গ্রামের কৃষকদের অনেকের কাছেই চলমান- চিত্রের কোন ধারণাই ছিল না। অন্ধকারের ভেতর একটি জগত ফুঁড়ে ওঠে, যা জীবনকেও অতিক্রম করে যায়—এরকম একটি প্রযুক্তি চলতি প্রত্যক্ষণে সামলে নেয়া অনেকের জন্য ছিল স্নায়বিক ও মনোজাগতিক চ্যালেঞ্জ। ১৯৬৫-তে আমাদেরই এক আত্মীয়, গ্রাম থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবে। বইপাগল মেধাবি ছেলে। সবাই নিশ্চিত সে বোর্ডে স্থান পাবে। পরীক্ষার দু’মাস আগে আরেক আত্মীয় তাকে রুপবান দেখাতে নিয়ে যায়। সিনেমা সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না। কিন্তু যা দেখল, হুরের মত সুন্দর একটি মেয়ে গানের পর গান গাইছে ও কাঁদছে, তা তার প্রত্যক্ষণকে ভেঙেচুড়ে দিল। সে কোনভাবেই বুঝতে পারল না কীভাবে অন্ধকারের ভেতর এরকম একটি অতিবাস্তব জগত তৈরি হয়। এও কী সম্ভব! ছেলেটি দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো। সেই থেকে সে আর কারও সাথে কথা বলে না। পরীক্ষায় ফেল করলো। লোকে বলল সে বায়ুগ্রস্ত।
এরকম অল্পবিস্তর ঘটনা সিনেমার ইতিহাসে ঘটেছে বিভিন্ন জনপদে। সিনেমাকে মানুষের সনাতন প্রত্যক্ষণে বোধগম্য করতে তাই ফিজি ও মাইক্রনেশিয়ায় সিনেমা প্রদর্শনের সময় লাউডস্পিকারে একজন কথক ধারাবাহিকভাবে গল্পটি বলে যেত মাত্র দু’দশক আগেও। কথক নিজের মতো করে ইম্প্রোভাইজ করতো জনগণের সাংস্কৃতিক ও মানসিক অবস্থাকে লক্ষ্যে রেখে।
ষাট দশকের শেষ থেকে উল্কার গতিতে সিনেমা আমাদের হয়ে গেলো। সিনেমা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ডিসকোর্স তৈরি করল, আমাদের মনোজগতে সিনেমা অনেকটা নির্দেশক হয়ে উঠলো। আমাদের জীবন হল সিনেমাময়। দেশজুড়ে সিনেমাহল তৈরি হল, যা ২০০০ সনে সংখ্যায় ১৪৫৫টি।
কিন্তু তারপর থেকে উল্টোযাত্রা। আজও আমরা সিনেমা দেখি, হয়তো আগের চাইতে বেশিই দেখি। কিন্তু সিনেমাহলে যাই না, সিনেমা দেখি অন্য প্লাটফর্মে। গড়ে ওঠা সিনেমহলগুলো গুড়িয়ে পড়তে লাগল। ২০১৮-তে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা এসে দাঁড়াল ২১৭টি, এবং করোনার আগে মাত্র ৭৩টি সিনেমাহল চালু ছিল।
২৮ ডিসেম্বর সিনেমার জন্মদিন। ১৮৯৫-এ এদিনে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়—অগস্ত লুই নিকলাস ও লুই জঁ—প্যারিসে সিনেমা শিল্প ও প্রযুক্তির দ্বার খুলে দেন। প্রথম বাণিজ্যিক ছবির প্রদর্শন করেছিলেন তারা। এরপর দ্রুত সিনেমা ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বব্যাপী। অচিরেই সিনেমা এলো আমাদের উপমহাদেশে, এলো আমাদের দেশে। আমাদের কৃষি-সমাজে, যখন মানুষ সবে মাত্র শিক্ষা ও চাকুরি সূত্রে শহরে আসতে শুরু করেছে, এখানে জীবন হয়ে উঠেছিল সিনেমাময়, আজ যা শুধুই স্মৃতি।