সর্বমহলে সমান জনপ্রিয় এক সঙ্গীতশিল্পী তিনি। বিশ্বজুড়ে বাঙালিদের কাছে সমাদৃত তিনি। নিজেকে বারবার উত্তরণ করে এখন তিনি দেশ সেরা গণসঙ্গীত শিল্পী। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সকল গণআন্দোলনের পুরোটা তিনি। সাধারণ মানুষের জন্য গান বেঁধেছেন। মুকুন্দরায়, কানাইলাল শীল, আলতাফ মাহমুদ, অজিত রায়ের পথ বেয়ে তিনি এককভাবে ইতিহাস রচনা করেছেন। উদাত্ত কণ্ঠে লোকায়ত স্টাইলে গলা ছেড়ে তিনি গান মানুষের জন্য গেয়ে থাকেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে গান তৈরি করতে পারেন। তিনি দেশের আনাচে কানাচে ছুটে ছুটে গান করেন। তিনি প্রবাসী বাঙালীদের সামনে স্বদেশ চেতনার বাণী তুলে ধরেন। ওপার বাংলাতেও তিনি সমান জনপ্রিয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পর তার অবস্থান।
তার নাম ফকির আলমগীর। তিনি ফকির। তিনিই আবার বাদশা। ফরিদপুরে তার আদি বাড়ি। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সারাজীবন তিনি সহজ মানুষ। সাধারণ পোশাক পরেন। এক মাথা ঝাঁকড়া ঢুল। সবসময় তিনি মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করেন। ছোট বড় নির্বিশেষে সকলেই তার বন্ধু। ছোট-বড়, খ্যাত-অখ্যাত, ধনী-গবির কোনো প্রভেদ নেই। সবাই সমান ফকির আলমগীরের কাছে। ফকির আলমগীর সকল খানে সহজ ও স্বচ্ছন্দ্য। সবার সঙ্গে খোলা মনে কথা বলে যাচ্ছেন। তাই অনেক সময় তার প্রকৃত মূল্য আমরা দিতে কৃপণতা করি।
টেলিভিশনের করিডরে, চ্যানেল আইয়ের স্টুডিওতে, শিল্পকলা একাডেমির চত্ত্বরে, জাতীয় জাদুঘরে, টিএসসিতে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে- সকলখানে ফকির আলমগীর সহজ মানুষ। সত্যিকারের ‘স্টার’ বলতে আমরা তাকেই বুঝি। গণ মানুষের শিল্পী তিনি। রিকশা’ অলাদের নিয়ে তিনি গান বেঁধেছেন। ও সখিনা গেছস কিনা ভুইল্যা আমারে। এই গান বাংলার আপামর মানুষের প্রিয় গান। সখিনার বয়ানে তিনি আরও গান গেয়েছেন। রিকশা’অলার এক বিরহী কাতর স্ত্রীর নাম সখিনা। তার কাতরতা নিয়ে বেদনা ও হাহাকারের গান। সমগ্র বাংলাগানে এমন সহজ সরল প্রাণময় জীবন ঘনিষ্ঠ গান আর কি আছে? আমার জানা নেই।
সখিনার গান ফকির আলমগীরকে অমরত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পপগানের জোয়ারে দেশ ভাসছে। সেই ধারায় ফকিরের আগমন। আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ এদের সাথে ফকির আলমগীর। পুরো দেশকে তারা মাতিয়ে তোলেন। ফকির আলমগীর পপ গান দিয়ে শুরু করলেও কিছুদিনের মধ্যে গণসঙ্গীতের বিস্তৃত ক্ষেত্রে পদচারণা শুরু করেন। এবং অবিলম্বে তিনি হাটের গান, মাঠের গান দিয়ে জনচিত্ত জয় করেন।
ফকির আলমগীর দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে সম্মাননা দিয়েছেন। নানা সাফল্যে তার ভান্ডার পূর্ণ।
ফকির আলমগীরের নিজস্ব শিল্পীগোষ্ঠী আছে। নাম ‘ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী’। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কাজ করে তারা সংগঠন হিসাবেও শীর্ষে আছেন। এর অবদান ফকির আলমগীরের একক। পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের আয়োজনের উল্টোদিকে গত বিশ বছর ধরে “ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী বর্ষবরণ আয়োজন করে আসছে। এটাও এখন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। চ্যানেল আই ঋষিজের এই আয়োজনটি সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে।
ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সম্মাননা প্রদান করে থাকে। এছাড়া ঋষিজের উপদেষ্টা আলতাফ আলী হাসু স্মরণে ছড়া কবিদের জন্য একটি পুরষ্কার প্রবর্তন করে আসছে। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা এই পুরষ্কার পেয়েছেন।
ফকির আলমগীরের এক জন্মদিনে জাতীয় জাদুঘরের আয়োজিত তার একক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। অসাধারণ পারফরমেন্স। কথা, স্মৃতি আর গান। উদাত্ত গলায় ফকির আলমগীর একের পর এক গান গেয়ে যান।
আমাদের পরম গুরু আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, ফকির আলমগীরকে অসম্ভব পছন্দ করেন। তিনি বলেন, ফকির অনেক বড় কাজ করে চলেছে। ওতো খুব মেধাবী। একঘেঁয়ে বাংলা গানকে ও আরেক ধারায় মুক্তি দিয়েছে। কণ্ঠে সুরের ধারা জাদু নেই। মায়াজাল নাই। কিন্তু আশ্চর্য রকমের মৌলিক তার গান। ফকির আলমগীর তাই দর্শকচিত্ত জয় করেছে। ফকির সরল শিল্পী। তড়বড় করে কথা বলে। কারো উপরে কোন রাগ অভিমান নেই। শুধু গান গাওয়ার তীব্র লোভ ও আগ্রহ তার। গান গাইতে না পারলে ফকির আলমগীর পাগল হয়ে ওঠে। এমন আকুতি ভরা শিল্পী খুব কম দেখা যায়। অনেক প্রতিভা না থাকলে দর্শক হৃদয় জয় করা যায় না।
ফকির আলমগীর স্বয়ং আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে ‘গুরু’ মানেন। স্যারের সঙ্গে দেখা হলে ভক্তও বিনয়ের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। খ্যাতির আড়ালে টের পাওয়া যায়, কির আলমগীর শিশুর মতো।
ফকির আলমগীরের সীমাহীন প্রতিভা। তিনি একজন স্বত:স্ফূর্ত লেখক। খ্যাতনামা প্রকাশনা থেকে তার অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে। স্মৃতিকথা, গণসঙ্গীতের ইতিহাস, বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মৃতি-ভ্রমণ মূলত এসব নিয়েই তার বইগুলো।
অসম্ভব পারিবারিক বলয়ে থাকা মানুষ। প্রেম করে ভাবীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। ভাবী তার ছায়াসঙ্গী। ফকির ভাইয়ের অভিভাবকও বলা চলে তাকে। খুব প্রেমিক-হৃদয়ের ব্যক্তি তিনি। অনেক বিখ্যাত মহিলাকে দেখেছি- অকপটে তার ফকিরের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। প্রয়াত রাশেদা মহিউদ্দিন কিংবা প্রয়াত গায়িকা পিলু মমতাজের কথাও প্রসঙ্গে মনে পড়ছে।
যাহোক- পল রবসনকে তিনি ভালোবাসেন। মুকুন্দ রায় বা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের প্রতি তার গভীর প্রেম। একদা ক্যাসেট বাণিজ্যে তিনি ছিলেন টপ চার্র্টে। নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে তার অনেক গান। লিলিন চে’গুয়েভারা তার প্রিয় চরিত্র তিনি গানের মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলেন। তিনি ভাসানীর সমর্থক। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত।
এমন আদিম ও মৌলিক মানুষ আমাদের সমাজে দ্বিতীয়টি নেই। আমরা প্রত্যেকেই ফকির আলমগীরের ভক্ত।
তিনি একক। তার কোন তুলনা নাই।
॥ দুই ॥
ফকির আলমগীরের অনেক বর্ণাঢ্য জীবন। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের সময় লাল টুপি পরে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ব্যানারে মাঠে মাঠে গেয়ে মাতিয়ে দিলেন বাংলাদেশ। ভয় কি মরণে, জনতার সংগ্রাম চলবেই এইসব গান। বিখ্যাত আজম খানও গণসঙ্গীত গাইতেন তখন। ১৯৭১-এ দুজনেই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন। আজম খান যুদ্ধাঙ্গণে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধের গান গাইলেন ফকির আলমগীর। কামাল লোহানী, নিজামুল হক, আলতাফ মাহমুদ- এদের সাহচর্যে বিকশিত হলেন তিনি। এসব ঘটনা বিষদ আকারে ফকির আলমগীর লিখে গেছেন তার বিভিন্ন গ্রন্থে। পপ সঙ্গীতের উত্তরাধিকার ব্যান্ড সঙ্গীত। আজম খান পপগুরু। কিন্তু ফকির আলমগীর পপের ধারায় লোক সঙ্গীতকে তুলে আনলেন। আজম খান যেন জর্জ হ্যারিসন। ফকির আলমগীর জন লেসন। মাইজ ভাণ্ডারি গানকেও ফকির আলমগীর পপ স্টাইলে গেয়ে মাতিয়ে দিলেন।
দুর্দান্ত প্রতিভা সম্পন্ন সঙ্গীতবোদ্ধা না হলে এমন বিকাশ সম্ভব নয়।
প্রায় ত্রিশটির মতো ক্যাসেট রেকর্ডিং হয়ে প্রকাশিত হয়। তার অনেক গান মানুষের মুখে মুখে। সে সব গান কালজয়ী।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে বিস্তারিত বললাম না। এ নিয়ে ফকির আলমগীর অনবদ্য বই লিখেছেন।
ফকির আলমগীর মানেই বাংলাদেশের অভ্যূদয়। বাংলার আকাশ-বাতাস, নদী-নালা। সবকিছুর সঙ্গে ফকির আলমগীরের সুর ও গান মিশে আছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গীত ভুবনে ফকির আলমগীর একাই একটি ধারার জনক।
তাকে সশ্রদ্ধা অভিবাদন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)