গত মার্চ মাস থেকে করোনাভাইরাস আর মৃত্যু সংবাদ শুনতে শুনতে মানসিক শক্তিকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। আবার জীবন আর জীবিকার যাতাকলে বর্তমান ও ভবিষৎকে কেবল অন্ধকারাছন্ন মনে হয়। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার করুণ দশা দেখে হতাশা যেন কন্ঠকে রোধ করে দেয়। চিকিৎসক ও রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য আর বাস্তবতার অমিল শুধু বোঝে এ শহরের ভুক্তভোগীরা।
ব্যক্তিগতভাবে পরিস্থিতির শিকার হয়ে সত্যি শঙ্কিত এখন নিজে। দিন চারেক আগে শারীরিক এক সমস্যার জন্য রাতের বেলায় একটা ইঞ্জেকশন পুশ করতে হন্য হয়ে খুঁজতে হয়েছে হাসপাতাল আর নার্সকে। এমনকি এলাকার ডিসপেনসারি মেডিক্যাল টেকশিয়ানরাও কাজটি করতে অসম্মতি জানায় করোনার ভয়ে। অগত্যা এক ডাক্তার বন্ধুর শরাপন্ন হয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল কোনমতে। রক্তনালিতে ইনজেকশন পুশ করলো আনাড়ি এক সিস্টার আর ওয়ার্ড বয় মিলে। সে এক দেখার মত দৃশ্য। পেইনের থেকে মুক্তি পেতে এত বড় রিস্ক নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তবে ডাক্তার বন্ধু না বলে দিলে হাসপাতালে লোক দরজা খুলত না তা বুঝতে পারলাম ওয়ার্ড বয়ের কথায়। যদি বেঁচে থাকি তাহলে বন্ধুর এ দয়ার কথা চিরদিন মনে রাখব।
রাতের বেলায় হাসপাতালে বলতে গেলে ডাক্তার নার্স স্টার্ফ কেউ থাকে না। চিকিৎসা পেশায় থেকে রোগকে ভয় করা সত্যি অবাক করে দেয়। অথচ চট্টগ্রামের চিকিৎসা নিয়ে হম্বিতম্বির অন্ত নেই হাসপাতালের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের। জনগণও প্রতিবাদ করছে সঠিক সেবার আশায়।
নিজের অসুস্থতার মাঝে মনে হচ্ছে এ কোন অদ্ভুত সময় পার করছি সবাই? চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর চিকিৎসক নার্সরা চিকিৎসা পেশায় আসে মানবসেবার ব্রত নিয়ে। কিন্তু দায়বদ্ধতা নেই কোথাও।
কোভিড-১৯ চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভিন্ন এক রূপ প্রকাশ করছে। এখানে শহরবাসীকে সেবা দেয়ার চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদের মাঝে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত লড়াই চলছে রোগীরদের সেবা ও হাসপাতালের কার্যক্রম নিয়ে। হাসপাতাল ও চিকিৎসক নেতারা প্রশাসনের সাথে মানুষের চিকিৎসা দেবার অঙ্গীকার করে। অথচ রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে আকুতি মিনতি করেও চিকিৎসা পায় ন। চেনা জানার সূত্রে অনুরোধ বা তদবির করে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর সৌভাগ্য সবার নাই। তাই হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মানুষ মরছে। যা এখন নিত্যদিনের খবর চট্টগ্রামের। বর্তমানে চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার বাড়ছে ক্রমাগত। অথচ চিকিৎসা ব্যবস্থায় হাহাকার ছাড়া আর কিছু নেই। আইসিইউ, অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মরছে। এখন করোনাভাইরাস শারীরিক অসুস্থতার সাথে সাথে মানসিক আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে। মৃত্যু ভয় তাড়া করছে ধনী গরীব সকলকে। তাই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে মানবিকতার মনোভাব নিয়ে নগরের বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদের হাত বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। কারণ কোভিড-১৯ এর জন্য সরকারিভাবে নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে সিট সংকট রয়েছে। এছাড়া আইসিইউ সুবিধাসহ অন্যান্য ব্যবস্থায় ও যথেষ্ট পরিমাণে নেই। তাই এ মুহুর্তে চিকিৎসক ক্ষেত্রে কোন রাজনৈতিক লড়াই যুদ্ধ বড় অশোভন।
কোভিড -১৯ এর ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা হিসাবে কাজ করতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের কথা মানুষ ভুলে যাবে না। কারণ তারা সাহসী সেনার মত মানবতার পেশার ব্রতকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। এ বীররা চিকিৎসা পেশার কাছে দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয়।
যুদ্ধের মাঠে মৃত্যু হতে পারে জেনেও সৈনিক যুদ্ধে যায়। করোনার এ সময়ে চিকিৎসকরা হলে সেই সৈনিক ; যাদের ছাড়া মানুষ অসহায়। তাই চট্টগ্রামের ৯০টি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক, চিকিৎসক,নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে অনুরোধ ‘প্লিজ এ শহরকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করবেন না।’ আপনারা রোগীদের সেবা দিন। করোনার মহামারী থেকে মানুষকে বাঁচান। বিনা চিকিৎসায় প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা অনেক বেশি। অন্তত মনে রাখা উচিত, মহামারীকালে মানবিকতার এ পেশায় মানুষের বিপন্নতাকে হাতিয়ার করে অর্থ বৈভবের চিন্তা বড় বেশি বেমানান ও বিবেকহীন কর্ম ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)