মানুষের চিন্তা-চেতনার বিকাশে যে বিষয়টি সর্বাধিক অধিপত্য বিস্তার করতে পারে, সেটি হলো শিক্ষা। প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে এবং মেধার যৌথ সমন্বয়ে মানুষ উন্নতির শীর্ষে নিজের অবস্থানকে নিশ্চিত করতে পারে।
সুতরাং শিক্ষা হচ্ছে উন্নয়নের পূর্বশর্ত এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংরক্ষণের রক্ষাকবজ। উন্নয়ন কার্যক্রম সফল করার মৌলিক সহায়ক শক্তি শিক্ষিত জনপদ। দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষর রেখে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলে তা কখনই সাফল্য লাভ করতে পারে না। এই সত্য উপলদ্ধি থেকেই মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য অতি প্রয়োজনীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে এবং হচ্ছে।
১৯৬৫ সালের ইরানের তেহরান শহরে ইউনেস্কোর আহ্বানে পৃথিবীর ৮৯টি দেশের শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাবিদ এবং পরিকল্পনাবিদ একত্রিত হয়ে আলাপ আলোচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, শিক্ষা জীবন ও জীবিকা পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বয়স্ক মানুষের ব্যাপক নিরক্ষতা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধক।
এই সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’ পালিত হচ্ছে। বিশ্বের সকল মানুষের মধ্যে শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বোধ জাগ্রত করা এবং নিরক্ষতা দূরীকরণে সমাজের সর্বস্তরে উদ্দীপনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের মূল লক্ষ্য।
বর্তমান বিশ্বের উন্নত দেশের বিশেষজ্ঞরাও বস্তুগত উন্নয়নের উপর প্রাধান্য না দিয়ে মানব সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রাধান্য দিচ্ছেন।
জানা যায়, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাক্ষরতার আনুমানিক গড় হার ৭০.৩০ শতাংশ। মানবসম্পদ উন্নয়ন না করে অন্য যে কোনো উন্নয়ন করতে চাইলে সে উন্নয়ন টিকিকে রাখা নিতান্তই অসম্ভব।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহের ন্যায় বাংলাদেশ সরকারও মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন থেকে শুরু করে কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
দেশের দরিদ্র ও অনগ্রসর পরিবারের শিশু কিশোর ও বয়স্ক নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি চালু করেছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের আওতায় উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ব্যবস্থায় সারাদেশে বিস্তার লাভ করছে সার্বিক সাক্ষরতা কর্মসূচি। ১৯৯১ সালে শতকরা ৩৫ শতাংশ বয়স্ক সাক্ষরতা কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু হয়।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রধানত চারটি স্তরে ভাগ করা যায়। এই স্তরের প্রথম ধাপ হিসেবে চিহ্নিত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য স্থাপিত ৬২ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতি বছর ১ কোটি ৮০ লাখ শিশু প্রবেশ করে। যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ। একই সাথে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে প্রবেশ করে মাত্র ৭৪ লাখ শিক্ষার্থী।
প্রশ্ন হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষ না করে-ই কেন শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ শিক্ষা স্তরে প্রবেশ করতে পারছে না? অনেক গুলো কারণের মধ্যে এর চিহ্নিত প্রধান কারণ হচ্ছে দারিদ্রতা। শুধুমাত্র দারিদ্রতার অভিশাপের ফলে শিক্ষার প্রকৃত জ্ঞান আহরন থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকে।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশ গুলোর সাথে সংগতি রেখে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করলে-ই কি সরকার বা সংশ্লিষ্ট মহলের দ্বায়িত্ব শেষ? শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে এবং প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি সাধন করতে তারা তেমন কোন পদক্ষেপ কি নিয়েছেন?
দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬০ শতাংশ এখনো দারিদ্র সীমানার নীচে বসবাস করছেন। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা কে সুদৃঢ় করণের জন্য সরকার কে অর্থনৈতিক দিকটির দিকে বিশেষ দৃষ্টি নিবন্ধন করতে হবে। বর্তমানে বিশ্ব স্বাক্ষর ধাপে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৪তম। ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডে এবং ২০০০ সালে সেনেগালের ডাকারে শিক্ষা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঘোষিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ অঙ্গীকারের প্রতি বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এমনকি বাংলাদেশের সংবিধানেও এ বিষয়ে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ এখনো সাক্ষরতার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অবিলম্বে এ সংক্রান্ত ব্যাপারে তৎপর হতে না পারলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে একটি অন্ধকার এবং কালো অধ্যায়ের!
১৯৯৭ সালে সাক্ষরতার হার শতকরা ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল শতকরা ৫৬ শতাংশ।
সরকারের পর্যালোচনায় শিক্ষার অগ্রগতির এই হার অব্যাহত রয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর এখন সাক্ষরতার পাশাপাশি অর্জিত সাক্ষরতার স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে অব্যাহত শিক্ষার ক্ষেত্রে।
মৌলিক স্বাক্ষরতা কর্মসূচির শেষে বিভিন্ন মেয়াদের সাক্ষরতার কর্মসূচির মাধ্যমে যাতে নব্য স্বাক্ষরগণ অর্জিত সাক্ষরতার চর্চা ধরে রাখতে পারে এবং সাক্ষরতাকে তার স্বীয় প্রয়োজনে দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা নির্বাহে কার্যকর ভাবে ব্যবহার করতে পারে এজন্য রয়েছে উপ-আনুষ্ঠানিক অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্যক্রম। এর মধ্যে রয়েছে দেশের ৬৪টি জেলায় গ্রাম শিক্ষা মিলন কেন্দ্র নামে ৯৩৫টি গ্রামীণ পাঠাগার।
এসব পাঠাগারে অব্যাহত শিক্ষা কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে সাক্ষরতা চর্চার পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরণের বৃত্তি মূলক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ সরকার অদূর ভবিষ্যতে নিরক্ষরতামুক্ত দেশ গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বদ্ধ। এই লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন বিশ্লেষন ধর্মী প্রতিবেদনের আলোকে জানা যায়, ইতোমধ্যে-ই বয়স্ক সাক্ষরতার হার শতকরা ৮৪ শতাংশে পৌঁছিয়েছে।
মানব সম্পদ উন্নয়নে অব্যাহত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সর্ম্পকে গণসচেনতা সৃষ্টির জন্য সমাজ উদ্ধুদ্ধকরণ কর্মকান্ড পরিচালনার বিকল্প কোন পন্থা নেই। এখন পর্যন্ত সমাজ উদ্ভুদ্ধকরণ কর্মকান্ডের লক্ষ্যে দল হচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু শিক্ষিত মানুষ। দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে স্বাক্ষরতা ও অব্যাহত শিক্ষার গণসচেতনতা ও আত্মোপলদ্ধির বিকাশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের মূল আহ্বান।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। একটি শিক্ষিত সমাজ ব্যবস্থা একদিকে যেমন পারে দেশ কে অগ্রগতির দিকে ধাবিত করতে, অপরদিকে ভূমিকা রাখতে পারে সামাজিক বা নৈতিক অবক্ষয়ের রাহু থেকে দেশ কে মুক্ত রাখতে। মোট কথা শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সুতরাং বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে, বিশ্বের দরবারে দেশটির ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হোক,সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।