২০১৭-১৮ সালের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের প্রধান সমালোচনা হচ্ছে ব্যাংক আমানতের উপর আফগারী শুল্ক। প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, বছরের যে কোনো সময় ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকার বেশি স্থিতি থাকলে আবগারী শুল্ক বিদ্যমান ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও ব্যাংকে ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত স্থিতির ক্ষেত্রে ১ হাজার ৫০০ টাকার বদলে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত স্থিতির ক্ষেত্রে ৭ হাজার ৫০০ টাকার বদলে ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার বেশি স্থিতিতে ১৫ হাজার টাকার বদলে ২৫ হাজার টাকা আবগারী শুল্ক আদায়ের কথা বলা হয়েছে মুহিতের প্রস্তাবে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, বছরের যে কোনো সময় ব্যাংক হিসাবে ২০ হাজার টাকার বেশি স্থিতি থাকলে আবগারী শুল্ক ৫০০ টাকা। যারা স্বল্প সঞ্চয় করেন তাদের বেশ বড় একটা ছাড় দেওয়া হয়েছেঃ এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত আমানতের উপর এখন আফগারী শুল্ক দিতে হবে না। ২০ হাজার টাকার উপর ৫০০ টাকা শুল্ক মানে শুল্ক হার ২.৫%। ১ লক্ষ টাকার উপর ৮০০ টাকা শুল্ক মানে শুল্ক হার ০.০৮%। যদিও শুল্কের হার কমেছে তথাপি এবারের বাজেট আলোচনায় এই বিষয়টি ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত এই শুল্ক নিয়ে আলোচনা চলছে। এই আলোচনা ব্যাপকতা পাওয়ার প্রধান কারণ ফেসবুকে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা একটি পোষ্ট। সে পোষ্টে অংক করে দেখানো হয়েছে যে কেউ যদি ১ লক্ষ টাকা ৩ মাসের জন্য স্থায়ী আমানত রাখে তবে তার আমানত কমে যাবে। সাধারণ মানুষ আতংকিত হয়েছে। আলোচনাটা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মূলধারার মিডিয়ায় চলে এসেছে; সেখান থেকে সুশীল সমাজের গোলটেবিল আলোচনা হয়ে জাতীয় সংসদে।
আমানতের উপর সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে এক লক্ষ টাকার তিন মাসের আমানতকারীর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ঐ পরিমাণ টাকা চার মাস বা তার বেশী জমা রাখলে আর নেতিবাচক ফল হয় না। বাজেট প্রণয়ণে যারা কাজ করেছেন তারা এই সূক্ষ্ম অংকটি করে দেখেননি। রাষ্ট্রীয় আইনকানুন এমন হওয়া উচিত নয় যে তা আমানতকারীর আমানতের পরিমাণ কমিয়ে দেবে। ন্যায্যতার এই ঘাটতির কারণে পুরো বাজেটটি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। অর্থমন্ত্রীর বিগত নয় বছরের ধারাবাহিক সাফল্যকে তথ্য দূর্বৃত্বরা বিফল বানিয়ে প্রপাগাণ্ডা করে বেড়াচ্ছে।
ব্যাংকের একটা সার্ভিস চার্জ দরকার তা না হলে একাউন্ট চালিয়ে রাখার খরচ আসবেই বা কোথা থেকে। সার্ভিস চার্জ ছাড়াও ব্যাংকগুলো আমানতের উপর যে সুদ দেয় তার থেকে অনেক বেশী সুদ আদায় করে মক্কেলকে দেয়া ঋণের উপর সুদ আদায় করে। আমাদের দেশে এই দুই হারের পার্থক্য ৪/৫ শতাংশের মত। উন্নত অর্থনীতির দেশে তা ১/২ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ২/৩ শতাংশ বেশী আয় করার সুযোগ পায়। তাদের নীট মুনাফা আকাশছোঁয়া। কোন কোন বেসরকারী ব্যাংক ১০০% এর উপরে নীট মুনাফা করে থাকে যা সিমপ্লি অস্বাভাবিক। এত মুনাফা করার সুযোগ কোনভাবে থাকা উচিত নয়। এই মুনাফার পরিমাণ কমানো যায় এবং একই সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেনের পরিমাণ বাড়ানো যায় যদি ব্যাংক ঋণের সুদের হার অপরিবর্তীত রেখে আমানতের উপর সুদের হার আরও ২% বাড়ানো যায়।
সার্ভিস চার্জের উপর ভ্যাট আদায় যৌক্তিক হলেও কোন মতেই যৌক্তিক নয় আফগারী শুল্ক। ভ্যাট আইন চালু হওয়ার আগে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য বিক্রয়ের উপর বিক্রয় কর আদায়ের পাশাপাশি আফগারী শুল্ক আদায় করা হত। ভ্যাট আইন চালুর সময় বলা হয়েছিল যে সকল রকমের আভ্যন্তরীণ কর বাতিল করে শুধু ভ্যাট আদায় করা হবে। বিক্রয় করা বাতিল করা হলেও সকল ক্ষেত্র থেকে তুলে নেয়া হয়নি আফগারী শুল্ক। বর্তমানে ব্যাংক একাউন্টে আমানতের উপর যে শুল্ক আদায় করা হচ্ছে তার নৈতিক কোন ভিত্তি নেই। অর্থমন্ত্রী বলেছেন এই শুল্কের নাম পরিবর্তন করা হবে। নাম পরিবর্তন করে কি নৈতিকতা আরোপ করা যাবে? নাম পরিবর্তন কেন, পুরো আইনটাই তুলে নেয়া উচিত। আফগারী শুল্ক তুলে নিলে রাজস্ব আদায় অনেকখানী কমে যাবে। সে ঘাটতি পূরণ করা যাবে আয়করের আওতা বাড়িয়ে, বিলাস দ্রব্যের উপর ভ্যাটের হার বাড়িয়ে।
সঞ্চয়পত্রের উপর সুদের হার কমানোর ঘোষণা আসার পর হতাশা বেড়েছে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সিটিজেনদের মধ্যে। তাদের আয়ের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত সুদ। এর উপর থেকে এক শতাংশ সুদ কমানো হয়ে তার প্রভাব পড়ে তাদের খাদ্য এবং চিকিৎসা খরচের উপর। শক্তিশালী মূলধন বাজারের অনুপস্থিতিতে অবসরপ্রাপ্ত মানুষদের একমাত্র বিনিয়োগের স্থান সঞ্চয়পত্র। বিনিয়োগ বৃদ্ধির অজুহাতে কোনভাবেই উচিত হবে না সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর। সঞ্চয়পত্র সরকারের জন্য এক নির্ঝঞ্ঝাট ঋণ গ্রহণ মাধ্যম। বেসরকারী খাত থেকে ঋণ গ্রহণ কমিয়ে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করলে ব্যাংকিং সিস্টেমের উপর ঋণ চাহিদা কম থাকে। ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের পরিমাণ কম হয়; বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।
বেসরকারী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে হারে বিভিন্ন রকম আমানতের উপর সুদ দিয়ে থাকে সঞ্চয়পত্রের সুদ তার থেকে কিছু বেশী হওয়া উচিত। এই বাড়তি সুদ খরচটি বয়স্ক মানুষদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে খরচ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাজারের অন্যান্য সুদের হারের চাইতে বেশী হলে সাধারণ মানুষ তফশিলভুক্ত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে অর্থ জমা না রেখে সকলেই সঞ্চয়পত্র কিনতে চাইবে। সরকার এত বিশাল চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। এ সমস্যা সমাধান করতে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারার যোগ্যতা নির্ধারন করা যেতে পারে এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের উপর আয়কর রেয়াতের সুবিধা তুলে দিয়ে নতুন কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ রেয়াতের ব্যাবস্থা করা যেতে পারে।
একই হারে যেমন আয়কর আদায় করা হয় না। তেমনি একই হারে ভ্যাট আদায় করাটাও উচিত নয়। যে সমস্ত পণ্য দরিদ্র মানুষ কেনে এবং যা নিত্য প্রয়োজনীয় তার উপর কোন ভ্যাট থাকবে না। প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় এক হাজার এ রকম পণ্যকে ভ্যাট আইনের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। যেসকল পণ্য মধ্যবিত্ত কেনে সেগুলোকে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এই তিন প্রকারের পণ্যের উপর যথাক্রমে ৫%, ১০% এবং ১৫% ভ্যাটারোপ করা যেতে পারে। উচ্চবিত্তের মানুষেরা যে সকল পণ্য ব্যবহার করেন তাঁর উপর ৩০% পর্যন্ত ভ্যাট আরোপ করলে তা সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে।
একই হারে ভ্যাট আদায় করার কৌশল পৃথিবীকে শিখিয়েছে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার আইএমএফ। এতে ধনী-গরীব এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ও বিলাসদ্রব্য নির্বিশেষে একই হারে করারোপ করায় স্বল্পায়াশে বেশী পরিমাণ কর আদায় করা যায়; সাধারণ মানুষের উপর রাষ্ট্রীয় খরচের একটা বড় অংশ চাপিয়ে দেয়া যায় বলে ধনবানেরা রেহাই পায়; বৃদ্ধি পায় পায় ধনী-দরিদ্যের অর্থনৈতিক বৈষম্য। পুঁজিবাদ যুগে-যুগে, দেশে-দেশে একাজই করেছে। ধনীর স্বার্থ রক্ষা করে দেশ গঠনের দায় চাপিয়েছে গরিবের উপর। গরিবের টাকায় সৃষ্ট অবকাঠামো ব্যবহার করে বড় বড় শিল্প-কারখানা স্থাপন করে, শ্রমিক শোষণ করে আরও বেশী মুনাফা বানানোর কৌশল তৈরী করেছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের হাতিয়ার আইএমএফ এর চাপিয়ে দেয়া একই হারে ভ্যাট আদায় থেকে বেড়িয়ে এসে সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব প্রতিটি জনহিতৈষী সরকারের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)