চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

প্রবাসী প্রজন্মের হাতে বাংলা লেখা

প্রবাসী প্রথম প্রজন্মের সাথে বাংলাদেশের বন্ধনটা অনেক দৃঢ় কারণ তারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, বাংলাদেশের আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছে। এরপর জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় দেশে কাটিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে। তাই বিদেশের হাজার টানা পোড়েনেও তাদের মনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য একটা নিঃস্বার্থ ভালোলাগা কাজ করে। তারা দেশ থেকে অবধারিতভাবেই বাংলা বলা, পড়া এবং লেখা শিখে আসে তাই সেগুলোর চর্চাও অব্যাহত থাকে। তাদের বিভিন্ন আড্ডাও চলে বাংলায়। আর অবধারিতভাবেই সেখানে আসে একেবারে বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতিসহ সবকিছুই। আর পাশাপাশি চলে বাংলা বই পড়ার অভ্যাসটাও। বাংলা বইয়ের যোগানদাতা বাংলাদেশের অনলাইন বইয়ের দোকানগুলো। অবশ্য প্রবাসেও অনেকেই বাংলা বই নিয়ে এসে বিক্রি করেন। সেখান থেকেও বাংলা বই সংগ্রহ করে পড়া যায়। আর যারা সামান্য লেখালেখি করেন তারাও বাংলাতেই লেখালেখি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এভাবেই প্রবাসে চলে প্রথম প্রজন্মের বাংলা চর্চা।

এতো গেলো প্রথম প্রজন্মের বাংলা চর্চার কথা। প্রথম প্রজন্মের জন্য বাংলা চর্চা যতটা সহজ দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্য ঠিক ততটাই কঠিন। কারণ দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রথম ভাষা হচ্ছে ইংরেজি আর দ্বিতীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা। তাই ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা শেখাটা অনেকটা বিলাসিতা বা বাহুল্যের পর্যায়ে পরে। কারণ বিদেশে দৈন্দন্দিন কথাবার্তা থেকে শুরু করে চাকরি খোঁজা সবকিছুতেই ইংরেজির প্রাধান্য। আর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যমও ইংরেজি। তাই দ্বিতীয় প্রজন্ম ইংরেজি শিখে যায় অবধারিতভাবেই। এর বাইরে বাংলা শেখাটা বেশ কঠিন। অবশ্য বেশিরভাগ দেশেই কমিউনিটি স্কুলগুলোতে বিভিন্ন দেশের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়াতেও বহু সংস্কৃতি এবং বহু ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট জোর দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা অধিদপ্তরের একটা শাখা আছে কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজ শেখানোর জন্য। তার অধীনে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষেরা কমিউনিটি স্কুলগুলোর নিবন্ধন করে সেখানে তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মকে তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতির শিক্ষা দেন।

এসব কমিউনিটি স্কুল সপ্তাহান্তের কোন একটা দিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসে। এই স্কুলগুলোর জন্য আলাদা কোন ভবন থাকে না সাধারণত। স্থানীয় পাবলিক স্কুলগুলোতে কয়েকটা কক্ষে চলে সেগুলোর পাঠদান। এই সময়টুকুতে দ্বিতীয় প্রজন্ম সে দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতির শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু যেহেতু সপ্তাহে মাত্র একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য চলে এই পাঠদান তাই ভাষা শিক্ষার এই দায়িত্ত্ব পুরোটা বর্তায় পরিবারের উপর। যে পরিবারে প্রথম প্রজন্মের ভাষায় কথা বলা হয় সে পরিবারের শিশুরা অবধারিতবেই সেই দেশের ভাষা বলতে পারে। আর বাবা মায়ের ঐকান্তিক চেষ্টা থাকলে সেই দেশের ভাষাটা পড়তে এবং কোন সময় লিখতেও শিখে যায়। এভাবেই প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্ম প্রথম প্রজন্মের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে। কতদূর পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় কিন্তু প্রথম প্রজন্ম এই ভেবে সন্তুষ্ট থাকে যে অন্ততপক্ষে যখন দ্বিতীয় প্রজন্ম দেশে ফেলে আসা আত্মীয় পরিজনের সাথে কথা বলবে তখন যেন তাদের কথা বুঝতে পারে এবং সেই মোতাবেক উত্তর করতে পারে।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি দ্বিতীয় প্রজন্মকে নিজের ফেলে আসা দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়া কতটা কঠিন। ইংরেজি ভাষার বর্ণমালাতে মাত্র ২৬ টা অক্ষর তার মধ্যে ৫ টা স্বরবর্ণ আর বাকি ২১টা ব্যঞ্জন বর্ণ। কিন্তু বাংলা ভাষায় ১১ টা স্বরবর্ণ এবং ৩৯ টা ব্যঞ্জনবর্ণ। সংখ্যার অনুপাতে বাংলা ভাষার স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ইংরেজির প্রায় দ্বিগুণ। তার মানে কেউ যদি বাংলা ভাষা শিখতে চায় তাকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার তুলনায় দ্বিগুণ পরিশ্রম বা খাটতে হবে। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে স্বরবর্ণগুলো ইংরেজির মতো শব্দে সবসময় সরাসরি ব্যবহার হয় না তার বদলে স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ কার’ই বেশি ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে বাংলা ভাষায় আরো রয়েছে বিভিন্ন রকমের ফলা’র ব্যবহার। উপরন্তু আছে যুক্তাক্ষর। যুক্তাক্ষগুলোর যদি একাধিক বর্ণের শুধু যুক্ত রূপ হতো তাহলে সমস্যা ছিলো না কিন্তু যখন আলাদা আলাদা বর্ণ যুক্ত হয়ে একটা যুক্তাক্ষর গঠন করে তখন বেশিরভাগ সময়েই তার আকৃতি বদলে যায়। সেগুলোকে চেনার জন্য আরো আলাদা দক্ষতার প্রয়োজন হয়।

এশফিল্ডের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধে নিশি

এতগুলো প্রতিবন্ধতা কাটিয়ে যে বাচ্চাটা একটা ভাষা শিখবে ব্যবহারিক জীবনে সেই ভাষার প্রয়োগ নেই বললেই চলে তাই একবার শিখতে পারলেও সেটা ধরে রাখা মুশিকল হয়ে দাড়ায়। কিন্তু সেখানে যদি বাংলার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষা যেটার চল আছে এবং বিভিন্ন কাজে লাগে যেমন ‘মান্দারিন’ ভাষা সেগুলোর ব্যাপারেই দ্বিতীয় প্রজন্মকে আগ্রহী দেখা যায়। অবশ্য অন্য একটা ভাষা জানার জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে না কি একটা পয়েন্ট যোগ হয়। সেটাতো বাংলা ছাড়া অন্য যেকোন ভাষা শিখলেও হবে। উপরন্তু যদি বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষা শিখে সেটার ব্যবহারিক প্রয়োগও আছে। তাই শুধু শুধু কষ্ট করে বাংলা শেখাটা আসলে বাহুল্য হয়ে দাড়ায়। ফলাফল দাড়ায় কেউই তেমন বাংলা শেখার ব্যাপারে আর আগ্রহ দেখায় না। আবার একশ্রেণীর অভিভাবক আছেন তারা এটা নিয়ে গর্ব করেন যে তাদের সন্তানেরা বাংলা বুঝে না। আমি ঠিক জানি না উনারা নিজেরা যখন বাংলা বলেন তখন মনেমনে ঠিক কি ভাবেন?

এরপরও একেবারে হাতেগোণা কিছু অভিভাবক নিজেদের আন্তরিক চেষ্টায় দ্বিতীয় প্রজন্মকে বাংলা ভাষা বলা, পড়া এবং লেখার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। এতেকরে একদিকে যেমন সেই অভিভাবককে যেমন তাঁর বাচ্চাকে আলাদা করে সময় দিতে হয় বাংলা শেখানোর জন্য। তেমনি সেই বাচ্চাটারও বাংলার প্রতি আগ্রহ থাকতে হয়। বাংলা বলার জন্য তেমন কোন কসরৎ করতে হয় না। পরিবারে বাংলা বলার চল থাকলে দ্বিতীয় প্রজন্ম অবধারিতভাবেই বলাটা শিখে যায়। পড়া আর লেখার জন্য একটু কষ্ট করতে হয়। পড়ার জন্য বাসায় ইংরেজি বইয়ের পাশাপাশি বাংলা বইও থাকতে হয়। আর দেশ থেকে বাংলা বই নিয়ে আসা বেশ ঝক্কির কাজ। আর লেখার জন্য অবশ্যই নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন হয় তা নাহলে লেখাটা ধরে রাখাই সবচেয়ে মুশকিল হয়ে যায়।

আমার বন্ধু নিশি, অবশ্য পরিচয় হয়েছে অস্ট্রেলিয়া আসার পর আমাদের ৯৬-৯৮ অস্ট্রেলিয়া গ্রুপের মাধ্যমে। আমরা বাংলাদেশের মনে হয় সবচেয়ে সৌভাগ্যবান প্রজন্ম যারা একইসাথে বাংলাদেশের এনালগ এবং ডিজিটাল রূপটা দেখেছি। আমাদের জন্ম হয়েছিলো সাদাকালো চৌদ্দ ইঞ্চি টিভির যুগে। ফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে ফোন করতে হতো তখন। এরপর বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের হাতে এসেছে কম্পিউটার, মোবাইল ফোনের মতো সব যুগান্তকারী আবিষ্কার। এরফলে আমরা খুব সহজেই বাংলাদেশের বিবর্তনের ধারাটা বুঝতে পারি। এতে করে একদিকে আমাদের মধ্যে একইসাথে রয়েছে এনালগ যুগের আত্মীয় পরিজনের নিঃস্বার্থ বুকভরা ভালোবাসার স্মৃতি। অন্যদিকে রয়েছে প্রযুক্তির দক্ষতা। এরপর যখন আমরা প্রবাস জীবনে পারি দিয়েছি তখন বুকের মধ্যে বহন করে এনেছি মাতৃভূমির সেইসব ভালোবাসার স্মৃতি। তাই বাংলাদেশের বাইরে থাকলেও আমাদের মধ্যে দেশের প্রতি একটা টান কাজ করে সবসময়।

নিশির মধ্যে এই টানটা বরাবরই বেশি। নিশির বাবা ছিলেন বাংলাদেশের চলচিত্রের অন্যতম খ্যাতনামা চিত্রনাট্যকার রুহুল আমিন দুলাল যিনি বাংলা চলচ্চিত্রে হেনরি আমিন নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। আর ও নিজেও একসময় শখের বসে মডেলিংয়ে নাম লিখিয়েছিলো। পাশাপাশি ওর গানের গলাও চমৎকার। ওর গানের নিজস্ব একটা ইউটিউব চ্যানেলও (https://www.youtube.com/user/nishipaul2k) আছে। এককথায় ওদের পরিবারটা যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বিদেশে এসেও নিশি তার অন্তরে লালন করে চলেছে বাংলাদেশকে। নিশির পোশাক আশাকে সবসময়ই বাংলাদেশের ঐতিহ্য প্রাধাণ্য পায়। এরপর যখন ওর ছেলে আরিক পড়াশোনা শুরু করলো তখন থেকেই ওর মনের মধ্যে একটা ইচ্ছে ছিলো তাকে বাংলা ভাষা বলার পাশাপাশি পড়তে এবং লিখতে শেখানোর। আগেই বলেছি প্রবাসে সেটা ঠিক কতখানি কঠিন। সেই বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আরিক এখন বাংলা বলা এবং পড়ার পাশাপাশি লিখতেও পারে। সে আবার শুধু সামান্য লিখতে পেরেই থেমে থাকেনি। নিজের মাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য নিজে থেকে বাংলায় একটা পুরো গল্প লিখে ফেলেছে। আরিক এখন একটা হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ে।
এরপর নিশি আরিকের লেখা গল্পটার ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছে। আমি সাধারণত এই ধরণের আবেগের বিষয়গুলো মিস করি না। পড়তে না পারলে সেভ করে রাখি পরে পড়ার জন্য। আরিকের লেখাটা সেভ করে রেখেছিলাম। এরপর একসময় পুরোটা পড়লাম। প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন চার পাতার একটা গল্প লিখে ফেলেছে এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বানান ভুল নেই বললেই চলে। অবশ্য নিশি লিখেছে লেখার সময় আরিক ওর কাছ থেকে জ/য, স/শ/ষ, র/ড়, এ/য়ে তফাৎগুলো জেনে নিয়েছে। কিন্তু তার মাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে সে বিষয়বস্তু আগে থেকেই বলে দেয়নি। আরিকের লেখাটা বাংলা লেখা হিসেবে যতখানি সুন্দর ঠিক তেমনি তার বিষয়বস্তুও অনেক মমতামাখানো। এখানেই আরিকের বিশেষত্ব।

আরিকের সাথে নিশি

আরিকের লেখাটা আমাকে একটা বিষয় মনে করিয়ে দিয়েছে সেটা হলো স্বদিচ্ছা থাকলে আসলেই কোন কিছু অসম্ভব না। আমি মনে মনে একটা স্বপ্ন সবসময়ই দেখি সেটা হলো আরিকের মতো আমাদের প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্ম বাংলা লিখতে পারবে। তারা ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও দক্ষ হবে। ওরা বাংলাটা শিখবে কিন্তু বাংলাদেশের নেগেটিভ বিষয়গুলো কখনওই ওদের কল্পনায় ধরা দেবে না কারণ ওদের কল্পনার বাংলাদেশ অনেক বেশি সুন্দর। ওরা বহু ভাষাভাষীর দেশ অস্ট্রেলিয়াতে বাংলার চর্চাটা চালিয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ওরা ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা শিখে বিশ্বমানের নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে। আর পাশাপাশি উজ্জ্বল করবে বাংলাদেশের নাম। ওরাই বিশ্বের বুকে তুলে ধরবে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। ওরাই হবে বিশ্বে বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিনিধি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)