চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও সিনহার কী স্বপ্ন ছিল?

মা স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমি এইচএসসি পাস করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করবো। আমি আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করিনি। ভেঙেছি আমার মায়ের স্বপ্ন। কাজেই আমার মা বলতেই পারেন আমি ওনার স্বপ্ন ভেঙেছি। সুরেন্দ্র কুমার সিনহার মাও নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিলেন ওনার ছেলে একদিন আইনজীবী হবেন, দেশের প্রধান বিচারপতি যে হবেন সেই স্বপ্ন নিশ্চয়ই তিনি দেখেননি।

অথচ সুরেব্দ্র কুমার সিনহা দেশের আইনজীবী, বিচারপতি, এমনকি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও নাকি ওনার স্বপ্ন ভেঙে গেছে। এদেশের একজন সামান্য আয়করদাতা হিসেবে প্রশ্ন করতেই পারি, প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরেও জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আসলে কী স্বপ্ন দেখেছিলেন? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নাকি বড় কোন ডাকাত দলের সর্দার হওয়ার? যে স্বপ্ন উনার পূরণ হয়নি কিংবা পূরণ হতে দেয়নি নির্বাহী বিভাগ?

কিছু লোক আছে যারা “ক” বললেই বুঝে নেওয়া যায় যে শব্দটা কলা হবে। এস কে সিনহার স্বপ্ন ভঙ্গ ঐটাই, তিনি ষোড়শ সংশোধনীর বিতর্কিত রায় দিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন এই দেশে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ করতে। সেই স্বপ্নের প্রাথমিক অংশ হিসেবে এস কে সিনহা ষোড়শ সংশোধনীর বিতর্কিত রায়ের মধ্যে তিনটা স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন। প্রথমত, রায়ের মাধ্যমে বর্তমান সংসদকে অবৈধ ঘোষাণার পথ করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং তৃতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন।

এই স্বপ্ন পূরণের অংশ হিসেবে বিএনপিপন্থী দু’জন আইনজীবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন তৈরি করে রেখেছিলেন। সিনহার স্বপ্ন ছিল রিভিউ রায়ে পরবর্তী তিন মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সংশোধনী দেওয়ার। স্বপ্ন পূরণে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের দ্বিতীয় রিট হতো ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করার। এ সংক্রান্ত একটি রিট হাইকোর্ট বেঞ্চ খারিজ করেছিল। এস কে সিনহা তার স্বপ্ন পূরণের সেই রিট আপিল বিভাগে দ্রুত নিষ্পত্তি করে এই সংসদকে অবৈধ এবং তিন মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে রায় দিয়ে দিতেন। তারপরে বর্তমান সংসদ বাতিল হয়ে যেতো, বর্তমান সরকারও অবৈধ হয়ে ক্ষমতা হারাতো। স্বপ্ন পূরণে প্রধান বিচারপতি হিসেবে সিনহার নেতৃত্বে গঠিত হতো ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার’, তারপরে সেই সরকার বেশ কয়েক বছর দেশ চালাতো। এই ছিল এস কে সিনহার স্বপ্ন। 

সিনহার এই স্বপ্নের মধ্যে খালেদা জিয়া লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের বাচ্চার সাথে খেলাধুলা করতে থাকেন, অপেক্ষা করতে থাকেন ঢাকা থেকে ফোন যাবে, সরকার পতন হয়ে গেল বলে। এদিকে তার স্বপ্নের বীজ বপন আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা টের পেয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ান। তারা সিনহাকে ‘রাজনৈতিক বিতর্ক’ থেকে সর্বোচ্চ আদালতকে দূরে রাখার পরামর্শ দেন এবং এস কে সিনহাকে জানিয়ে দেন তার দুঃস্বপ্ন পুরনের দ্বায় তারা নেবেন না।

তিনি বুঝতে পারেন, আপিল বিভাগের কোনো বিচারপতি তার দেখা দুঃস্বপ্ন পূরণে সাহায্য করবেন না, বরং নিজে থেকে কিছু করতে গেলে পড়বেন চরম বিপদে, তারপরে এস কে সিনহা বাধ্য হয়ে দেখা দুঃস্বপ্নের কাছে আত্মসর্মপন করেন। এবং ভেঙে যায় উনার স্বপ্ন, তারপরে চালাক সিনহা ক্যান্সারের কথা বলে কোনো রকমে ছুটি নিয়ে প্রথমে সিঙ্গাপুর, তারপরে অস্ট্রেলিয়া হয়ে কানাডা অতঃপর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে লিখে ফেলেন এ ব্রোকেন ড্রিম। এই ছিল এ ব্রোকেন ড্রিম বা একটি স্বপ্ন ভঙ্গ বাই সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

এবার আসুন মূল ব্যাখ্যায়। অবশ্যই বিশ্বাস করি আত্মজীবনী লেখা কোনো অপরাধ নয়, তবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কপিপেস্ট আত্মজীবনী লেখাটাকে এক ধরনের অপরাধ বলেই মনে করছি। প্রশ্ন করতে পারেন, কীভাবে কপিপেষ্ট আত্মজীবনী হল এটা? উত্তর হলো সুরেন্দ্র কুমার সিনহার এ ব্রোকেন ড্রিমকে আপনি এই জন্য একটি কপিপেষ্ট আত্মজীবনী বলবেন, এই ৬১০ পৃষ্ঠার আত্মজীবনীর প্রায় প্রতিটা শব্দ বা অক্ষর গত ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবরের পর থেকে বাংলাদেশের বিএনপি জামায়াতি গোষ্ঠী প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সভা সেমিনার আলাপ আলোচনা টক শো’তে কলের গানের মতো বাজিয়েই চলেছে। দেশে আইনের শাসন নেই, নিরাপত্তা নাই, সুরেন্দ্র কুমারের ক্যান্সার হয়নি, সুরেন্দ্র কুমারকে পালিয়ে যেতে হয়েছে ইত্যাদি যা দিয়ে ৬১০ পৃষ্ঠার করে সিনহা সাহেব অন্তত দুইটা আত্মজীবনী লিখতে পারতেন। অথচ লিখলেন মাত্র একটা। কাজেই এ ব্রোকেন ড্রিমকে একটা কপিপেষ্ট আত্মজীবনী বলতেই পারেন। 

এ ব্রোকেন ড্রিম নিয়ে ভাবনার অনেক কিছু হতো, যদি তাতে লেখা থাকতো সিনহার বিরুদ্ধে আনিত ১১টি দুর্নীতির অভিযোগের সকল বিবরণ, যদি উল্লেখ থাকতো ফখরুদ্দিন মঈনুদ্দিন সমর্থিত সেনা সরকারের সময়ে দুর্নীতির দ্বায়ে গ্রেপ্তার আশংকা ও ভয় পেয়ে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকায় গ্রেপ্তার এড়ানোর ঘটনা, যদি উল্লেখ থাকতো ফার্মার্স ব্যাংকের ৪ কোটি টাকার গল্প, যদি উল্লেখ থাকতো সিঙ্গাপুরের প্যারাগন হাউসে ফ্ল্যাটের মালিকানার গল্প, যদি উল্লেখ থাকতো সাবেক পিএস রনঞ্জিত বাবুর মাধ্যমে অর্জন করা সারাদেশে শত কোটি টাকার সম্পদের বিবরণ, যদি উল্লেখ থাকতো রাজাকার সাকার পরিবারের সাথে লন্ডনে বসে নাস্তা খাওয়ার গল্প, তাহলে ঠিক ছিল যে  সিনহা সাহেবের এ ব্রোকেন ড্রিম একজন পালিয়ে যাওয়া বীরের সত্যিকারের গল্প এটা, সকলের পড়া উচিত এবং বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

সেদিন এক বিএনপি নেতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তো আওয়ামী লীগের প্রোডাক্ট। এই প্রোডাক্ট আওয়ামী লীগ রাখবে, নাকি ফেলে দিবে এটা নিয়ে আপনাদের এতো চিন্তা কেন? যেখানে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিচারপতি জীবনের শুরুর রেকর্ড আওয়ামী লীগের ১৯৯৯ আমলের অপরদিকে প্রধান বিচারপতি সেটাও আওয়ামী লীগ আমলের ২০১৫ সালের। সেই শুরু থেকে অর্থ্যাৎ ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৬ সালের শেষ পর্যন্ত সিনহার পক্ষে কোনদিন স্ট্যান্ড নেননি, সেখানে এখন অবস্থাটা এমন হয়েছে যে আপনাদের ফখরুল, রিজভী, জয়নাল, মওদুদ সাহেবদের বক্তব্য শুনলে মাঝে মধ্যে ভুলেই যাই সিনহা কি দেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন নাকি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্য ছিলেন। উত্তরে বিএনপি নেতা হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, বিএনপি বাংলাদেশে আইন বিচার এসব খুব মান্য করে। উত্তরে বললাম, তাহলে খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায়কে রাজনৈতিক রায় বলে গলা ফাটাচ্ছেন কেন? যেখানে একটা মামলা ১০ বছর চলার মধ্যে আইনি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে নির্দোষ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে কেন এই সাজাকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি বলছেন?

সিনহা সত্যিকারের বীর ছিলেন কিনা তা হয়তো ইতিহাস নির্ধারণ করবে কোনো একসময়। তবে এইটুকু না বললেই নয়, উনি ওনার স্বপ্ন ভঙ্গের বইয়ে ভয়ের যে গল্প লিখলেন তা একদম মিথ্যা আর বানোয়াট। রাষ্ট্রের মূল তিন স্তম্ভের একটি স্তম্ভের প্রধান হিসেবে ওনাকে আরেকটা স্তম্ভের কোনো এক স্তরের একটা এজেন্সির লোক গিয়ে হুমকি দিবে তা একেবারে বাচ্চাদের সাথে দাদি নানীর ভুতের গল্পের মতো মনে হয়েছে। কারণ উনি যেখানে দাঁড়াবেন সেখানেই আদালতের শুরু অন্তত সংবিধান এই ক্ষমতাটুকু দিয়েই উনাকে প্রধান বিচারপতির শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিল। কাজেই যখন উনার কাছে কেউ গিয়েছিল পদত্যাগ করার কথা বলতে তখন ঐ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার হুকুম না দিয়ে যেই ব্যক্তি অসুখের কথা বলে ছুটি নিয়ে পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে, বিশ্বাস করি সেই ব্যক্তি অর্থাৎ সিনহা নৈতিকভাবে বিচারক পদে থাকার সকল সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং উনি একজন মেরুদণ্ডহীন অপদার্থ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছিলেন যার বিচার অবশ্যই এই মাটিতে হতে হবে, করতে হবে।

প্রধান বিচারপতি

পরিশেষে একটা বাস্তব ঘটনা বলেই শেষ করছি। চিত্র নায়িকা নাজনীন আক্তার হ্যাপির কথা মনে আছে তো? ক্রিকেট বলতে অজ্ঞান বাঙালির রুবেল প্রীতিতে যেই মেয়েটি বিচার চেয়েও বিচার পায়নি উল্টো পেয়েছিল গালি, এমন কোনো হীন ভাষা নেই যা তাকে শুনতে হয়নি। সেই হ্যাপিকে কিন্তু একটা সময় যারা তাকে গালি দিয়েছে তারাই আম্মা বলে ডেকে আদর্শিক নারী হিসেবে মূল্যায়ন করা শুরু করে যা এখনো অব্যাহত আছে। হ্যাপি কী করেছিল? শুধু হাফপ্যান্ট ছেড়ে বোরখা পড়া শুরু করেছিল। সিনহার ক্ষেত্রেও সেই রকম কিছুই হয়েছে। কারণ, সিনহাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়াটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জের, প্রথমত তিনি ছিলেন ভিন্ন ধর্মের যার প্রতিক্রিয়ায় এই দেশের এক শ্রেনীর মানুষ, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত তখন জানতে চেয়েছিল মুসলিম দেশে একজন হিন্দু বা নাস্তিক ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সাহস আওয়ামী লীগ সরকার কোথা থেকে পেয়েছে?

দ্বিতীয়ত তারা বলেছিল, ‘এস কে সিনহা ভারতের দালাল’। ভারতের এমন ‘দালাল’কে কেন প্রধান বিচারপতি বানাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার, এই দেশ কি ভারতের অংশ? এমন প্রশ্নই তুলেছিল তারা। অথচ এখন সেই বিধর্মী, নাস্তিক, ভারতের দালাল সিনহার জন্য বিএনপি-জামায়াত কাঁদতে কাঁদতে এখন চোখের নিচে কালি ফেলে দিয়েছে। কারণ সিনহা সাহেব সত্যিটা ছেড়ে মিথ্যা বলা শুরু করেছে বলে এখন তারা সিনহাকে আব্বু বলে ডেকে জীবন স্বার্থক করবে। আর এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। কাজেই সিনহা সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর দ্রুত তদন্ত করা উচিত এবং তদন্তে অপরাধ পাওয়া গেলে দেশে ফিরিয়ে এনে সিনহার অপরাধের বিচার করে বিচার বিভাগের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত বলেই মনে করছি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)