গত ২১ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে আবার নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই যাচাই বাছাই-এর মূল কাজটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় সমন্বয় করছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল-জামুকা। অনেক জেলা উপজেলাতে যাচাই-বাছাই এখন চলমান। আবেদনের বহর দেখে বুঝা যায়, কয়েক মাস ধরে এই যাচাই বাছাই চলবে। কিন্তু এই বাছাই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা হতে ইচ্ছুকদের বিশাল তালিকা দেখে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। প্রথমত: বিজয়ের এত বছর পরে এই যাচাই-বাছাই কতটা নিরপেক্ষ হবে। দ্বিতীয়ত: যারা প্রকৃত সম্মুখ সমরের বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা নিবন্ধিত হতে পারবে কিনা।
বর্তমানে সারাদেশে মুক্তিবার্তা লাল বই-এর তালিকা অনুযায়ী এক লক্ষ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ হাজার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। জামুকা সূত্রে জানা গেছে, এবার নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা হতে প্রায় দেড় লক্ষের কাছাকাছি অনলাইনে আবেদন পড়েছে। যে নামের তালিকা ইতিমধ্যেই দেশের উপজেলাগুলোতে টানানো হয়েছে। এর বাইরে অনেকেই মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশ করে নিয়ে গেছেন। দেড় লক্ষেরও বেশি নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্যে আবেদন করায় বুঝাই যাচ্ছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার বাইরে কী পরিমাণ অমুক্তিযোদ্ধা আবেদন করেছেন। নতুন করে যারা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্যে আবেদন করেছেন এর মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাই বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যারা বিভিন্ন কারণে বাদ পড়েছেন বা গেজেটধারী হতে পারেননি তারাও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। মাগুরা জেলাতে বর্তমানে দুই হাজারের বেশি ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও নতুন করে সেখানে প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্যে অনলাইনে আবেদন করেছেন। আবেদনের এই সংখ্যা দেখে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সবাই কমবেশি বিস্মিত। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই এত সংখ্যা দেখে লজ্জিত না হয়ে পারছেন না। আবেদনকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই ভুয়া, অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে বলে প্রতীয়মান।
পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে এমন অনেকেই নাকি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্যে আবেদন করেছেন যিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়াতো দূরে থাক যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সামান্য সহযোগিতা পর্যন্ত করেননি। বিভিন্ন জেলা-উপজেলাতে এমনও আবেদনকৃত ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে যিনি যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশেরই বিরোধিতা করেছেন। আবার অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ নিয়েছেন পারিবারিক পরিচয, অর্থবিত্ত এবং রাজনৈতিক বলয়ের কারণে। অনেক উপজেলাতে ঘুষ বাণিজ্যও শুরু হয়েছে। বিশেষ করে কিছু কিছু উপজেলার কমান্ডার বা তাদের নিযুক্ত ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে টাকা পর্যন্ত হাতড়িয়ে নিচ্ছেন- এরকম খবর বেরিয়েছে। খবর বেরিয়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার গেজেটধারী হওয়ার জন্যে দেদারসে টাকা পয়সা খরচ করছেন। আর তাই অনেক জায়গাতেই উপজেলা কমান্ডারদের ভাগ্যদ্বারও খুলে গেছে। আর তাই ঘরে বসেই তারা ‘নগদ নারায়ণ’ পাচ্ছেন। নতুন তালিকা প্রণয়ন প্রসঙ্গে কিছুদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন যথার্থই বলেছেন-মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যায় এক লাখ ৩০ হাজার থেকে দেড় লক্ষের বেশি হবে না। কিন্তু বারবার তালিকা করে বিষয়টি একেবারে হাস্যকর করে তোলা হয়েছে।
এদিকে আবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অনেকেই রয়েছেন যারা সম্মুখ সারির যোদ্ধা হয়েও নিজেদের খামখেয়ালী আর নির্বুদ্ধিতার কারণে গেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি। ভুয়াদের কারণে এসব মুক্তিযোদ্ধারা এবারও গেজেটধারী হতে পারবেন কিনা এনিয়ে তাদের সংশয়ের শেষ নেই। যেমনটি হতে পারেননি নদীয়ার চাপড়া ইয়থ ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার আবু তালেব বিশ্বাস। অনলাইনে তিনি আবেদন করেছেন। যাচাই-বাছাই এর তালিকায় তার নামও আছে। কিন্তু তিনি আদৌ গেজেটধারী হতে পারবেন কিনা এ নিয়ে তার সন্দেহের শেষ নেই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চান তিনি।
নতুন প্রক্রিয়ায় প্রতিটি উপজেলাতে সাত সদস্য বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটির সামনে আবেদনকৃত মুক্তিযোদ্ধার সহযোদ্ধা সাক্ষী দেবেন। প্রতিটি উপজেলাতে যে যাচাই বাছাই কমিটি করা হয়েছে সেখানে রয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল-এর প্রতিনিধি এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধি। কিন্তু অনেক উপজেলাতেই দেখা গেছে কমিটিতে যারা রয়েছেন তাদের বেশিরভাগই যুদ্ধের ময়দানেরই কেউ নন। কিন্তু যাচাই-বাছাই হতো তার হাত ধরেই। ফলে প্রকৃত যাচাই-বাছাই কতটা সঠিক হবে তা নিয়ে মিলিয়ন প্রশ্ন রয়ে গেছে।
১৪ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে খবর বেরিয়েছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়াতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ সংবাদ সম্মেলন করে খোদ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবু তাহের এলএমজিকে মুক্তিযাদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলন করা মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন আবু তাহের নিজেই একজন বিতর্কিক ব্যক্তি। তিনি কমিটিতে থাকলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা স্থান পেয়ে যেতে পারেন। শুধু সাতকানিয়া নয়, বিভিন্ন উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ পত্র-পত্রিকাতে এসেছে। পদাধিকার বলে উপজেলা কমান্ডার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির অন্যতম সদস্য হলেও এটাও সত্য যে অনেক উপজেলাতেই এমন অনেক কমান্ডার রয়েছেন। যার রণাঙ্গনে এক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ার রেকর্ড নাই। যিনি নিজ এলাকায় যুদ্ধের ময়দানে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিকে পুঁজি করে উপজেলা কমান্ডার নির্বাচিত হয়েছেন। এরকম প্রেক্ষিতে অনেক উপজেলা কামন্ডারদের বিরুদ্ধেই প্রকৃত-সৎ ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। বেশিরভাগ উপজেলাতে প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধারা মারা যাওয়ার কারণে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা নানা ছলেবলে চারদিকে নিজেদের এক ধরনের বলয় ও কর্তৃত্বও তৈরি করেছে। ফলে যাচাই-বাছাই এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের অন্ত নেই।
পত্রিকা মতে একথাটি সর্বাংশে সত্য যে, অনেক জেলা উপজেলাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে খোদ জেলা-উপজেলা কমান্ডার এবং তাদের নিযুক্ত প্রতিনিধিরা অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানাতে একধরনের জাল বিস্তার করেছে। যদিও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্পষ্টত এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, যদি কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে সাক্ষী দেন তাহলে সেই মুক্তিযোদ্ধার ভাতা এক মাস থেকে তিন বছরের জন্যে স্থগিত করে রাখা হবে। তবে এই আদেশ বা নির্দেশ যে খুব একটা কার্যকর হবে তা মনে হচ্ছে না।
আসলে যে প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই এর পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে সেই প্রক্রিয়ায় কতোটা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই হবে সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা যতই বাড়ানো হয়েছে সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আর এই সুবিধা বাড়ানোর সাথে সাথে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অংশ যেমন বিবিধ সুযোগ সুবিধা নেওয়ার জন্যে তদবিরে নেমেছে, তেমনি ভুয়াদের মিছিলও বেড়েছে। এই সরকার আসার পর ভাতা সুবিধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকেও দেখা গেছে বেশি ভাতা পাওয়ার লক্ষ্যে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া প্রত্যয়ন নিতে স্থানীয় এমপি বা মন্ত্রীর দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
অনেক আগে থেকেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এদিকে যে প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করার পদ্ধতি ঠিক করা হযেছে তাতে করে যে কোনো ভুয়া আবেদনকারীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত আছে। এই সরকার ক্ষমতা আসার পর বিভিন্ন থানা, জেলাতে প্রচুর সংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্ধানও পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত বছরের ২১ অক্টোবর দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, যশোর জেলার চৌগাছাতে ১৫৪ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে ভাতা বাতিল এবং ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে নির্দেশ দেন। এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা বিগত দিনের উপজেলা কমান্ডারদের হাত করে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বনে যান। শুধু চৌগাছা বলে নয়, বিভিন্ন জেলার কমান্ডাররা এরকম অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ আনলে অনেকের ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। দুদকও উদ্যোগী হয়ে সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলাতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা খুঁজতে তৎপরতা শুরু করে।
যে কথা আগেই বলেছি, বর্তমান যে পদ্ধতি অনুসরণ করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে করে ভুয়া বা অমুক্তিযোদ্ধার নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত রয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার বদলে ভুয়া আরও মুক্তিযোদ্ধা ফের নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ কেবলই বন্ধ করতে পারে আমাদের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই-যারা জেলা-উপজেলা যাচাই বাছাই কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে রয়েছেন। কে মুুক্তিযোদ্ধা আর কে মুক্তিযোদ্ধা নন এই পরীক্ষায়-প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কতোটা ভূমিকা রাখেন সেটাই দেখার বিষয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)