অবশেষে বিশেষ সুবিধা দেয়ায় খেলাপি ঋণের গতি থামলো। ৩ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ কমেছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজর ২৮৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।
কিন্তু বছরের ব্যবধানে সামান্য বেড়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তুলনায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মোট খেলাপি বেড়েছে ৪২০ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র নয়। কারণ ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়ার কারণেই খেলাপির পরিমাণ কম দেখা যাচ্ছে। বাস্তবে কমেনি।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে আর্থিক খাত। তাই সম্প্রতি খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপিদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। গণছাড়ের আওতায় বড় বড় ঋণ খেলাপিরা পুনঃতফসিল করেছেন। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে খেলাপি আইন শিথিল, অবলোপন নীতিমালায় ছাড়, স্বল্প সুদের ঋণের ব্যবস্থাসহ দেওয়া হয়েছে আরও বিশেষ সুবিধা। এর মধ্যে অর্ধলাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গণছাড়ের পরও এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪২০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়ার কারণেই কমেছে খেলাপি ঋণ। তাই বাস্তবতা বদলায়নি। বদলেছে খেলাপির হিসাব।
“এতদিন বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি কম দেখা গেছে। এখন এই ২২ হাজার কোটি টাকা এ খাতে যোগ হয়ে যাবে। অর্থাৎ বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশি দেখাবে। আগে যেটাকে ঋণ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হতো না সেটাকে এখন ঋণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। তখন দেখা যাবে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ বাড়ছে। অর্থনীতির দূর্বলতা কেটে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা কোনোভাবেই আশ্বস্ত করে না যে, ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পেয়েছেন যারা, তারা এই ঋণের অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগাবে, ঋণের কিস্তি নিয়মমাফিক পরিশোধ করবে, ভবিষ্যতে খেলাপি হওয়া থেকে বিরত থাকবেন কিংবা খেলাপি হলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রায় একই মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়ার কারণেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে। এছাড়া অন্য কোনো কারণ নয়।
তিনি বলেন, এটাতে ইতিবাচক তেমন কোনো লক্ষণ নেই। ঋণ পুনঃতফসিল সরকারের উদ্যোগ। এই সুযোগ দেয়ায় আপাতত খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখাবে। কিন্তু এটা স্থায়ীভাবে কমছে কি না সেটা বলা মুশকিল। এটা হয়তো আবার বেড়ে যাবে। তা ভবিষ্যতই বলে দিবে।
দুটো কারণে খেলাপির পরিমাণ কমছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলো অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছে। তারা তাদের পোর্টপোলিও ভাল করার জন্য চেষ্টা করছে। পাশাপাশি ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সুবিধা কার্যকর করায় খেলাপি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। যা জুনের শেষে ছিল ২০ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৬ মাসে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ৬ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা।
এই সময় সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছিল ১০ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। যা জুন মাসের শেষে ছিল ১২ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। এছাড়া এই সময় বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। যা জুন মাসের শেষে ছিল ৯ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। আর অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। যা জুনে ছিল ৬ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে গত বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক মানের খেলাপি নীতিমালায় শিথিলতা আনা হয়। আগে ৩ মাস অনাদায়ী থাকলেই তা খেলাপি হতো। এটি সংশোধন করে ৬ মাস এবং সর্বোচ্চ ১২ মাস অনাদায়ী থাকলে তবেই খেলাপি করা হয়।
অন্যদিকে খেলাপিদের গণছাড় দিতে বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করা হয়। গত বছরের মে মাসে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঋণখেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের মেয়াদে মাত্র ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন।
এই গণছাড়ের আওতায় ১৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছে ব্যাংকগুলো, যার অর্ধেকই করেছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েও গত বছর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫২ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকারি ৬ ব্যাংকের বিতরণ করা ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ২৪ শতাংশ বা ৪৩ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে।
অন্যদিকে ডিসেম্বরের শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। আর সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ৩ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৯ কোটি টাকা।