ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে সংঘটিত নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডের ‘পেছনের ঘটনা’ উদঘাটনে তদন্ত কমিশন গঠনসহ বেশ কিছু সুপারিশ এসেছে হাইকোর্টের রায়ে।
পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ যে রায় প্রকাশিত হয়েছে বুধবার সেখানে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারক মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার এবিষয়ে আলাদাভাবে ২২ দফা সুপারিশ করেছেন। আর রায় প্রদানকারী বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো.শওকত হোসেন এসব সুপারিশের সাথে সহমত প্রকাশ করেছেন।
আসামির সংখ্যার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই মামলা রায়ে বলা হয়েছে, ‘সরকার প্রয়োজন মনে করলে তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।’
প্রকাশিত রায়ে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী যে সুপারিশ করেছেন
- বাংলাদেশ রাইফেলসের নিরাপত্তা বিষয়ক ইউনিট আরএসইউ–কে মেধাবী, সৎ ও চৌকস সদস্যদের দিয়ে ঢেলে সাজানো এবং পিলাখানায় বিডিআর বিদ্রোহে দায়িত্বে অবহেলার জন্য ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা আরএসইউ এবং বিদ্রোহের পূর্বাভাস সংগ্রহে দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- বিডিআরে তীব্র অসন্তোষ ও প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণের বিষয়টি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাসহ কমান্ডিং অফিসারদের নজরে আসা সত্বেও তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনে উদ্যোগ গ্রহণ না করে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ভবিষ্যতের জন্যে সংশ্লিষ্টদের মনযোগী ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
- মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন মেধাবী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দক্ষ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিজিবির মহাপরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগে ব্যবস্থা গ্রহণ বিভাগীয় আইন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কিত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
- সামরিক অথবা বেসামরিক সকল শ্রেণির কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে সেবার মানসিকতা নিয়ে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পেশা, পদবী, সামাজিক পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সংবিধানে উল্লেখিত মূলনীতি অনুসরণ করে সকলের প্রতি মানবিক আচরণ ও সম্মান প্রদর্শনের মানষিকতায় বাহিনীকে গড়ে তোলা।
- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিজিবিসহ অধীনস্থ সকল বাহিনীর সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আন্তরিকভাবে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির আগেই কর্তৃপক্ষকে আইনসম্মত ও সম্মানজনক উপায়ে তার সমাধান খুঁজে বের করা।
- বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা। সকলকে আইনানুগভাবে সম্মানের সঙ্গে চাকরি করার সুযোগ সৃষ্টি এবং বিজিবির সদস্যদের পদোন্নতি, বেতন, ভাতা, রেশন, ছুটি, আবাসিক সমস্যা, চিকিৎসা ও সন্তানদের শিক্ষা গ্রহনের সুবিধাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উদ্ভুত সমস্যা দ্রুত সমাধানে মন্ত্রনালয়সহ সরকারের সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ।
- আইনানুগ কোনো বাধা না থাকলে বিজিবির সদস্যদের জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশ গ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের প্রতি সমান আচরণ করা। দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার কর্তৃক অধীনস্তদের প্রতি হানীকর আচরণ থেকে বিরত থাকা।
- পিলখানায় নিহত সামরিক, আধা-সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান, সেনা কর্মকর্তাসহ নিহতদের সন্তান বা পরিবারের সদস্যদের আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা বিধানে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির ব্যবস্থা করা।
- পুনর্গঠিত বিজিবি সংবিধান ও নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে দেশ-প্রেম, সততা ও শৃঙ্খলার সাথে দেশের সীমান্ত রক্ষাসহ তাদের উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব পেশাদার বাহিনী হিসাবে পালনের মাধ্যমে বিজিবির হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এবং দেশের সীমান্তরক্ষী হিসাবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বিজিবিকে শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
- সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীকে অপারেশন ডাল ভাতের মতো কোনো আর্থিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত না করা এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ‘ঘটনার পিছনের ঘটনা’ উৎঘাটন করতে তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
প্রকাশিত রায়ে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার যে সুপারিশ করেছেন
- শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসাবে বিজিবি সদস্যদের সম্মান হারায় এমন কোনো কর্মসূচি গ্রহণ না করা।
- কোন সমস্যা দেখা দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিজিবি কর্তৃপক্ষকে তা সমাধানে যত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
- অফিসার এবং সদস্যদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ থাকলে তা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।
- তাদের মধ্যে সৌহাদ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে পদক্ষেপ গ্রহণ।
- বিজিবি সদস্যদের পাওনা টিএ/ডিএ বিল যত দ্রুত সম্ভব পরিশোধ করা।
- ছুটিসহ বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করা।
- দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা অসদাচরণের জন্য আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ।
- অফিসার এবং সেনাদের মধ্যে অপ্রত্যাশিত ভাষা ও আচরণ পরিহার করতে হবে।
- পিলখানার অস্ত্রাগার কঠোর নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে গুলির শব্দ শোনা যেতে থাকে। বিডিআর সপ্তাহ চলার কারণে প্রথমে অনেকেই ভাবছিলেন ভেতরে হয়ত কোনো কর্মসূচি চলছে। কিন্তু পরে জানা যায় ভেতরে বিদ্রোহ হয়েছে এবং পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জওয়ানরা। এরপর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দপ্তরে বিদ্রোহের খবর পাওয়া যায়।
একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এরপর গভীর রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।
একপর্যায়ে পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের। তবে বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধের কাছে ম্যানহোলের মুখে দুই বিডিআর কর্মকর্তার লাশ পাওয়া যায়। আর বিদ্রোহ অবসানের পরদিন পিলখানায় পাওয়া যায় একাধিক গণকবর। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর নাম বদলে এই বাহিনী নাম দেয়া হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ওই বিদ্রোহের ঘটনার পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। সেখানে ছয় হাজার জওয়ানের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু পরে পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার শুরু হয় ঢাকার বিচারিক আদালতে। দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এই হত্যা মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এছাড়া সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয় ২৫৬ জনকে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন। পরবর্তীতে বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি। ৩৭০ কার্যদিবস শুনানির পর ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষনা করা তিন বিচারপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে বুধবার পূর্ণাঙ্গ সে রায় প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে এই রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেয়া হবে।