ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ ও বাম সমর্থিত শিক্ষকদের নীল দলের সাধারণ সভায় শিক্ষকদের দুই পক্ষের হাতাহাতির ঘটনায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে কাদা ছোড়াছুড়ি করেছেন শিক্ষকরা। গতকাল রোববার ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আয়োজিত মানববন্ধনে ঘটনার জন্য অন্যদের উপর দোষ চাপান শিক্ষকদের একাংশ। সোমবার আরেক পক্ষের শিক্ষকরা একই ঘটনায় একই স্থানে একই কর্মসূচি পালন করে প্রথম অংশের উপর দোষ চাপিয়েছেন। তবে এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি।
ঘটনার দিন ‘প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী’র ওপর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ‘অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন’ হামলা করেছিলেন বলে সোমবারের কর্মসূচিতে দাবি করা হয়। এর আগের দিন অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে ঠিক এর পাল্টা দাবি করে প্রক্টরের পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে।
উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে উভয় কর্মসূচিতেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। সোমবারের কর্মসূচির ব্যানারে লেখা ছিল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে শারীরিকভাবে আক্রমণের প্রতিবাদে মানববন্ধন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজ’। রোববারের কর্মসুচির ব্যানারে ছিল ‘অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দিনের উপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন’।
সোমবারের কর্মসূচিতে নীল দলের সাবেক আহ্বায়ক কবি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদের সভাপতিত্বে ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুর রহিম, সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম খান, অধ্যাপক সৈয়দ শামসুদ্দীন প্রমুখ। এতে মুঠোফোনে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে উপস্থিতিদের তার বক্তব্য শোনানো হয়।
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আজ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ এখানে দাঁড়িয়েছি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য।’
সভাপতির বক্তব্যে নীল দলের সাবেক আহ্বায়ক কবি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা রক্ষা করা সকলের দায়িত্ব। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান কে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে যাচ্ছে। একটি মহল পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় লিপ্ত। আমাদের মাঝে দ্বিমত থাকবে তবে শিক্ষার উন্নয়নে মান সমুন্নত রাখতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তিনি ‘হাতাহাতি’র ঘটনা নিয়ে শিক্ষকদের মিথ্যাচারের নিন্দা জানান এবং গণমাধ্যমকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করার আহ্বান জানান।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘নীল দলের সভায় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। সভায় বির্তক থাকবে এটি স্বাভাবিক। কিন্তু সেটিকে সুন্দরভাবে পরিবেশন করতে হবে। কিন্তু সেদিনের ঘটনা নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে, যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভাল নয়।’
এই কর্মসূচির মাত্র একদিন আগে প্রায় একই সময়ে ‘হাতাহাতি’র ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানীকে অপসারণের দাবি করেন নীল দলের শিক্ষকদের একাংশ।
ওই কর্মসূচিতে নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুল আজিজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূইঁয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সহিদ আকতার হোসাইন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী, সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ফজলুর রহমান, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বায়তুল্লাহ কাদেরী, কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা রহমান, শামসুন্নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া সাহা এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবুল মনসুর আহাম্মদ উপস্থিত ছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার নীল দলের এক সভায় হাতাহাতি’তে জড়িয়ে পড়েন সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বর্তমান উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সমর্থকরা। তখন আরেফিন সমর্থক জামাল উদ্দিনের উপর প্রক্টর গোলাম রব্বানীসহ তিনজন হামলা করেন বলে অভিযোগ উঠে।
ওই কর্মসূচিতে অধ্যাপক আব্দুল আজিজ বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা আসলেই লজ্জাজনক। শিক্ষক সমাজ যারা জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত, তারা ছাত্র ছাত্রীদের সামনে তাদের আচরণের দ্বারা যা প্রকাশ করেছে, তা আমাদের সম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ ঘটনাটি আমার চোখের সামনে ঘটছে, এঘটনায় আমি লজ্জিত এবং দুঃখিত। এই ঘটনায় জড়িতদের দৃশ্যমান শাস্তির দাবি জানিয়ে তিনি আরো বলেন, উপাচার্য আমাদেরকে বিচারের আশ্বাস দিয়েও বিচার করেনি, তাকে দৃশ্যমান কিছু করতে হবে।’ এসময় উপাচার্যের উপর তার আস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘এ ঘটনায় এতটাই লজ্জিত যে জনসম্মুখে কিছু বলতে চাই না। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে শিক্ষকদের নিয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া এসেছে, তা দেখেও আমি লজ্জিত, ক্ষুব্ধ ও হতবিহ্বল। এটাকে উপাচার্য আখতারুজ্জামান ও সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের গ্রুপের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা যাবে না। কারণ আরেফিন সিদ্দিক আমাদের নেতা ছিলেন, এখন আখতারুজ্জামানও আমাদের নেতা। যারা এটিকে আরেফিন সিদ্দিকপন্থি ও আখতারুজ্জামানপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করতে চান, তারা আসলে নীল দলকে ভাঙ্গতে চায়।’
হাতাহাতি’র ঘটনায় আহত অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘উপাচার্য ওয়াদা করেছিলেন অসৌজন্যমূলক ব্যবহারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেবেন, কিন্তু তিনি তা রক্ষা করেননি।’ প্রক্টর গোলাম রব্বানী ছাত্রজীবনে ছাত্রদলে যুক্ত ছিলেন বলে তার বক্তব্যে দাবি করেন তিনি।