চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

পরীক্ষা আর প্রশ্ন ফাঁসে দেশের মানবসম্পদ কি ধ্বংসের পথে?

কয়েক বছর পূর্বের এসএসসি কিংবা যে কোন পাবলিক পরীক্ষার চিত্র চোখের সামনে নিয়ে আসছি কল্পনায়। আমি সেই দৃশ্যটাই নিয়মিত দেখার স্বপ্ন দেখি। আমি আরো স্বপ্ন দেখি আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকেই দেশের জন্য সম্পদে পরিণত হবে। পরীক্ষার সময়ের চিত্রটাই এমন ছিল: অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যেত। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পরীক্ষা সংক্রান্ত নিউজগুলো পরিবেশন করতো। আর ছাত্র-ছাত্রীরা পত্রিকার নিউজে পড়াশোনা পৃষ্ঠায় বিশেষভাবে নজর রাখতো। বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের প্রদত্ত সাজেশন্সের আশায় দিন কাটতো এবং ভাল ফলাফলের আশায় টেস্ট পেপার মূল্যায়ন করে নিজেদের মান উন্নয়নের চেষ্টা করতো।

স্কুলভিত্তিক শিক্ষকদের সমন্বয়ে পরীক্ষার্থীদের জন্য স্পেশাল নিয়মকানুনের মাধ্যমে পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতেন। আমি গ্রামের ছেলে তাই গ্রামীণ আবহের চিত্রই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। পরীক্ষার সময়ে পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের আমেজ লেগে যেত, পরীক্ষার্থীরা সবার কাছ থেকে দোয়া নিতো পরীক্ষার পূর্ব মূহুর্তে এবং আমেজে আমেজে শেষ হতো পরীক্ষা শুরুর প্রথম পর্ব। এই দৃশ্যটা এখন আর কোথাও দেখা যায় না, কেমন যেন সবকিছুতেই নিষ্প্রাণ চলে আসছে।

সে সময়টায় পরীক্ষা হলের দৃশ্য কেমন ছিল তা আমাদের সকলের নিকট জ্ঞাত। পরীক্ষা হলে এক ছাত্র অন্য ছাত্রের নিকট থেকে কোন কিছু দেখা তো দূরের কথা, ঠিকভাবে একে অন্যের দিকে তাকাতেও পারতো না। এখন হলের ভেতরের পরিবেশ নিয়েও অনেকেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছেন। এমন ও খবর পাওয়া গেছে যেখানে শিক্ষকরা পরীক্ষার হলে ছাত্রদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে যা পরীক্ষার হলের নীতিবহির্ভূত। কিন্তু পূর্বে নকল করার চিন্তা তো সূদুর পরাহত ছিল। তবে যে দু’একজন নকলের দোষে দুষ্ট হতো না তা বলা যাবে না।

তবে যারাই নকল করতো পরীক্ষার হল থেকে তারা কোন না কোনভাবে বহিষ্কৃত হতো। তাই অন্যেরা নকলের চিন্তা করার সুযোগ ও পেতেন না। শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের উপর কড়া নজর রাখতেন এবং পরীক্ষার পরের দিন সংবাদমাধ্যমে কোন কেন্দ্রে কতজন ছাত্র-ছাত্রী ছাঁটাই হতেন তার পরিসংখ্যান পাওয়া যেতো। এখন তো বহিষ্কারের কোন খবর পত্রিকায় আসে না। তার মানে কি দাঁড়ালো আমাদের ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার হলে কেউই অসুদপায় অবলম্বন করে না। বিষয়টা কি আসলেই যৌক্তিক? সচেতন পাঠকমহলের উপর সিদ্ধান্তের দায়ভার দিয়ে দিলাম।

পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় দেখেছি শতকরা ৮০ নম্বর পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল, যদিও দু-একটা সাবজেক্টে পাওয়া সহজ হলেও অধিকাংশ সাবজেক্টে ৮০ উর্ধ্ব মার্কস অর্জন খুবই কঠিন ছিল। উপজেলায় দু-তিন জন ছাত্র-ছাত্রী স্টার মার্কস পেত, সিজিপিএ শুরুর সময়ে দেখা যেত উপজেলায় ৮-১০ জন এ প্লাস পেয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে কোন বিষয়ে ৮০ মার্কস পাওয়া কোন ব্যাপারই না। ফলাফল প্রকাশ হবার পরে দেখা যাচ্ছে গোল্ডেন এ প্লাস ছাড়া কোন মূল্যায়ন হয় না ছাত্রদের মেধাদের।

পরিসংখ্যানও বলছে পূর্বের তুলনায় আমাদের ছেলেমেয়েরা মেধাবী ও সৃজনশীল হিসেবে তৈরি হচ্ছে। প্রকৃতঅর্থে বাস্তবতা কি এমনই? পাঠকের নিকট উত্তরের ভার ছেড়ে দিচ্ছি। যদি গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা এতই মেধাবী হতো তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পাশের হার এতটা নগন্য হতো না। বিষয়গুলো খুবই ভাবনার এবং দুশ্চিন্তার। তাই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাববার বেশ কারণ রয়েছে।

একটা সময় ছিল অর্থাৎ আমি যে সময়ের বাস্তবতা টেনে আনছি সে সময়টায় পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে কোন ছাত্র-ছাত্রী এবং তার অভিভাবকেরা ক্ষুণাক্ষরেও ভাবনায় নিয়ে আসতে পারতো না। কিন্তু বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় বিষয়টি নিয়ে সকলেই অবগত রয়েছি। প্রশ্ন ফাঁস যেন একটা ট্র্যডিশনে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীরাসহ তাদের অভিভাবক এবং কোচিং নামক মরণফাঁদ প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত থাকে মর্মে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর বের হয়। পরীক্ষার পূর্বের রাতে ফেইসবুক ও বিভ্ন্নিজনের মেসেঞ্জারে হুবহু প্রশ্নের সেট পাওয়া যায়। সুতরাং যেখানে পূর্বে পরীক্ষার্থীদের ধ্যান জ্ঞান ছিল সিলেবাস সম্পূর্ণ শেষ করে পরীক্ষায় হলে প্রবেশ করবে। কিন্তু এখনকার চিত্র পুরোটাই ভিন্ন, প্রশ্নের আশায় বসে থাকে শিক্ষার্থীরা। প্রশ্ন দেখে প্রস্তুতি নেয়। বিষয়টা জাতি হিসেবে কতটা লজ্জার আমাদের জন্য!

এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা সম্পদে পরিণত না হয়ে অভিশাপে পরিণত হবে। জাতির জন্য ভবিষ্যৎ পথ অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পরিণত হবে। শিক্ষাব্যবস্থার এমন চিত্রের জন্য কোন এক পক্ষকে দায়ী করে আমাদের দায়মুক্তি মিলবে না। সকলের সম্মিলিত এবং আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। কারণ দেশটা আমাদের সকলের। এক শিক্ষামন্ত্রীকে দায়ী করে মন্ত্রণালয়ের উপর সমস্ত দায় চাপিয়ে বসে থাকলে চলবে না। কারণ, কোন মন্ত্রীই নিজেকে দোষী হিসেবে দেখতে চায় না। এ দৃষ্টিকোণ থেকেও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। কারণ এটি একটি জাতীয় সমস্যা। জাতীয় সমস্যাকে যত দ্রুত সম্ভব সমাধানে নিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন ফাঁস এবং তৎসংশ্লিষ্ট কাজে কারা প্রভাবক হিসেবে থাকতে পারে তাদেরকে সুর্নিদিষ্টভাবে চিহ্নিত করে ভয়াবহ শাস্তির আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই এবং সে ব্যাপারে সকলকেই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)