চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

পরম আত্মীয় ফজল-এ-খোদা

তাঁকে কোনোদিন বলা হয়নি, আপনাকে অভিবাদন। আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। আপনি সালাম সালাম হাজার সালামের লেখক। আপনি ‘পাকতাড়ুয়া’ শব্দটি নির্মাণ করেছেন। আপনি ছড়াকার। বাংলাদেশ বেতারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। একদা দুর্দান্ত শিশুসংগঠক। আপনি খুবই খ্যাতিমান সংগীত-রচয়িতা।

অনেক পরিচয় তাঁর। অনেক কর্মময় জীবন। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির ”স্নেহধন্য। অনেক তরুণকে তিনি উদার হস্তে ”স্নেহ বর্ষণ করেছেন।

এক আশ্চর্য মানুষ তিনি। শিশুর মতো সরল। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল শিশু-কিশোর কালে। রেডিও বাংলাদেশে ছড়া পড়তে গেছি। তাঁরই পরিকল্পনায় অনুষ্ঠান। দেখা হলো ব্যস্ত সেই ছোটোখাটো মানুষটির সাথে। খুব আন্তরিকভাবে কুশল বিনিময় করলেন, সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। আমাদের বালক বয়স। তাঁর তখন ভরা যৌবন। এক মাথা বাবরি-চুল। ডোরাকাটা একটা কোট পরনে। খুব আন্তরিক। জানলাম তিনি মিতাভাই। তিনি ‘শাপলা শালুক’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিন বছর। দেশব্যাপী গড়ে তুলেছিলেন শাপলা শালুকের আসর। তাঁরই লেখা সেই বিখ্যাত গান:
যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে
যে দেশেতে কলমি কমল কনক হয়ে হাসে
সে আমাদের জন্মভূমি মাতৃভূমি বাংলাদেশ ॥

হাঁ তাঁর নাম ফজল-এ-খোদা (১৯৪১-২০২১ )। আমাদের প্রিয় এক মানুষ। আমার প্রিয় ছড়াকবি তিনি। খুব নিভৃতচারী। দলবাজি ও ভিড় এড়িয়ে ”স্নিগ্ধ জীবন যাপন করে গেলেন। তাঁর বড়ো সন্তান ওয়াসিফ-এ-খোদা। আমাদের খুব ঘনিষ্ঠজন। অনুজ বন্ধু। ওয়াসিফ বড়ো হলো আমাদের সামনেই হাসতে হাসতে। ওয়াসিফের সেই হাসি এখনও অমলিন। যখনই দেখা হবে, কথা হবে তখনই ওয়াসিফ একপ্রস্থ হাসি দিয়ে আলোচনা শুরু করবে। ওয়াসিফের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে যাওয়ায় ফজল-এ-খোদার সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এলো। কারণ ওয়াসিফের কাছেই বাবার সব খবরাখবর পাই। ওয়াসিফরা এখন থাকে বাবর রোডে। বাংলাদেশ বেতার কার্যালয় আগারগাঁওতে। তারই উলটোদিকে কোনো এক কোয়ার্টারে জীবনের দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন।

তাঁকে আমরা ‘খোদা ভাই’ সম্বোধন করি। ছোটোবেলায় ভাবতাম, ড. কুদরাত-এ-খুদার তিনি হয়তো নিকট আত্মীয়! কিছুদিনের মধ্যেই সে ভুল ভাঙল।

খোদা ভাইয়ের সঙ্গে বেতারের কার্যালয় ছাড়াও দেখা হয়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশনে। তিনি সেখানে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। আমরা ছিলাম আলী ইমাম ভাইয়ের সহকারী। টেলিভিশনে নিয়মিত কাজ করতাম। খোদা ভাই একইরকম আন্তরিকতায় স্বল্পভাষণে বলতেন, কী আমীরুল, কেমন আছ? তোমার লেখা নিয়মিত পড়ছি। ভালো লিখছ। লজ্জায় মাথা নত করে রাখতাম।

কয়েক বছর আগে ‘গানে গানে সকাল শুরু’ অনুষ্ঠানে ফজল-এ-খোদাকে নিয়ে এলাম। আবদুল জব্বার এবং ফজল-এ-খোদা। সালাম সালাম হাজার সালাম গানটি নির্মাণের স্মৃতিকথা বললেন তাঁরা। খোদা ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন। বারবার বললেন, আমীরুল ছোটোদের একটা নিয়মিত অনুষ্ঠান করো। আমি তোমাদের সাথে আছি।

অনেক প্রতিশ্রুতি যেমন জীবনে পালন করা হয় না, তেমনি ফজল-এ-খোদার সাথে অনুষ্ঠানও করা হয়নি আমাদের। শুনেছি, বয়সের কারণে খোদা ভাই এখন স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যাচ্ছেন। বর্ণাঢ্য জীবন। ধূসর হয়ে গেছে সব স্মৃতি! খোদা ভাই একটা বই স্মৃতিকথা লিখেছেন : আলো ছায়ার জোয়ার-ভাটা।

লোক হিসাবেও তিনি খুব দরদি মনের লেখক। ছড়া রচনায় খুব আন্তরিক। জয় মুক্তিযুদ্ধ, আড়ি, টুনটুনি তাঁর ছড়াগ্রন্থ। রয়েল বেঙ্গল নামে তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ আছে। সবিনয়ে উল্লেখ করতে চাই-বইটি আমাকে উৎসর্গ করা। লেখা আছে : ছড়াবিদ আমীরুল ইসলাম। এছাড়াও খোদা ভাই টুনটুনি ছড়ার বইটি প্রিয় এগারোজনকে উৎসর্গ করেছেন। সেই এগারো ছড়াকবির মধ্যে আমিও একজন। এ আমার অনেক বড়ো গর্ব।

খোদা ভাই আমার ছড়া নিয়মিত পড়তেন। ওয়াসিফ আমার ছড়া রচনাবলী পাঁচ খ-ই নিয়ে গিয়েছিল বাবার জন্য। খোদা ভাই মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। আর ওয়াসিফকে বলতেন, আমীরুলের ছড়া অন্যরকম। ও আলাদাভাবে লেখে। ওয়াসিফ বাবার সঙ্গে একমত। এবং আমাকে সেসব কথা বলত খুব গর্ব নিয়ে। খোদা ভাইয়ের মন্তব্যে আমিও গর্ববোধ করতাম। এ আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি।

ফজল-এ-খোদা খুব বিখ্যাত সংগীত-রচয়িতা : এ কথা সবাই জানেন। সালাম সালাম হাজার সালাম ছাড়াও তাঁর লেখা দু-একটি গানের কথা উল্লেখ করতেই হয়। যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসেÑগানটির সুর দিয়েছিলেন আবেদ হোসেন খান। খুব বেশি গান তিনি সুরারোপ করেননি। আরেকটি গান : কলসি কাঁখে ঘাটে যায় কোন রূপসী। ধীর আলী মিয়ার সুর। বাসন্তী রং শাড়ি পরে কোন বঁধুয়া চলে যায়-খোন্দকার ফারুক আহমদের গাওয়া ষাট দশকের জনপ্রিয় গান।
তাঁর একটি ছড়াগান শুনতে শুনতে ছোটোবেলা পার করেছি-
খোকনমণি রাগ করে না
বায়না অমন ধরে না

মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গাওয়া। এই গানে শিশুকণ্ঠ দিয়েছিলেন শিমুল ইউসুফ। এই গান শোনেনি এমন চল্লিশোর্ধ ব্যক্তি বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশ বেতারে অনুষ্ঠান নির্মাণ ছাড়াও বেতার বাংলা ও শাপলা শালুক পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। শাপলা শালুক পত্রিকাটার ২৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তাতেই ব্যাপক আলোচিত হয় এই শিশু-কিশোর মাসিকটি। দেশ জুড়ে বেতারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শাপলা শালুকের আসর নামের শিশুসংগঠন গড়ে ওঠে। অল্প সময়ে খুব আলোচিত সংগঠন।

স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশ জুড়ে শিশুসংগঠনের কার্যক্রম ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুসংগঠনের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। খোদা ভাই বলেছিলেন শাপলা শালুকের আসরের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল নভেম্বরে, ১৯৭৫ সালে। কিন্তু চরম দুর্ভাগ্য! ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সব এলোমেলো হয়ে যায়। সংগঠনটিও স্তিমিত হয়ে আসে।

ওয়াসিফের মধ্যে দিয়ে ফজল-এ-খোদা সবসময় আমাদের মধ্যে জীবন্ত থাকেন। শুনেছি-খোদা ভাইয়ের এখন অখণ্ড অবসর। শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। তিন নাতনি আছে। ওয়াসিফের তিন মেয়ে। একসাথে জন্ম নিয়েছে। বিন্তি, বিন্দি আর বিন্নি। খোদা ভাইয়ের রাখা নাম। নাতনিদের সাথেও দিনের অনেকটা সময় কেটে যায়।

ফজল-এ-খোদার অনেক গৌরবময় জীবন। সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি কি পেয়েছেন? একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার কোনোটাই তিনি পাননি। এই দীনতা ও লজ্জা নিশ্চয়ই আমাদের। কিন্তু মানুষের যে ভালোবাসা আপনি পেয়েছেন তার মূল্যও কম নয়। আপনার মতো সৎ, নির্বিরোধী, শান্ত মানুষ কয়জন আছেন? শিশুর মতো জীবন যাপন করে গেলেন। এতেই আপনার আনন্দ। কত কথা বলার ছিল বলা হলো না। যেখনে থাকুন ভালো থাকুন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)