গত ৮ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে এক ঘোষণায় ভারতে প্রচলিত ৫০০ এবং ১ হাজার রুপির নোট নিষিদ্ধ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নোরেন্দ্র মোদি। পুরনো ছেড়ে নতুন কিছু আশায় তেমন কোনো বিতর্ক ছাড়াই সেটা গ্রহণ করেছিল সবাই। কিন্তু সাধারণ মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি আর পেরেশানির কারণে দিন তিনেক না যেতেই নতুনত্বের আশা ফিকে হয়ে গেছে। যা নিয়ে ভারতজুড়ে এখন রাজনৈতিক উত্তাপও তুঙ্গে।
কেন্দ্র ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দেওয়ায় ভারতজুড়ে হাহাকার পড়ে যায়। পুরনো নোট বদলানোর জন্য ব্যাংকে ব্যাংকে ভিড় জমায় মানুষ। নতুন টাকা তোলার জন্য ছুটে বেড়ায় এটিএমগুলিতে। কিন্তু সেখানেও পরিষেবা যেন থমকে গেছে। এটিএমবুথে কোনো টাকা নেই। পুরো ভারতে মাত্র ৪০ শতাংশেরও কম বুথ কাজ করছে। টাকা বদলানোর লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটানার সাথে মানুষের মৃত্যু ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।
মানুষের ভোগান্তির পর এখন প্রশ্ন উঠছে এই কাজের জন্য সরকারের আগাম কোনো প্রস্তুতি ছিল কি না। কোনো কোনো গণমাধ্যমে সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে কড়া সমালোচনা পর্যন্ত লিখেছে। তারা বলছে, এটিএমগুলোতে যে দৃশ্য দেখা গেল, যা ঘটলো, এই বিপর্যয় বুঝিয়ে দিলো সরকার অনেক বড় বড় কথা বললেও এর আড়ালে আসলে চূড়ান্ত প্রস্তুতিহীনতা ছিল।
নতুন কিছু আশায় প্রথমদিন কষ্ট সহ্য করে বিজেপি সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছিল সাধারণ মানুষ। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের একাশংকে দেখা গেছে সেলফির জোড়ারে ভাসতে। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় ছাড়া তখন কেউই এ ব্যাপারে বা মানুষের ভোগান্তি নিয়ে কথা বলেননি। কিন্তু দিন গড়াতেই সাধারণ মানুষের ক্ষোভের সাথে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ। মমতার সাথে সুর মিলিয়েছে আরো বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। কংগ্রেস, আম আদমি, সমাজবাদী পার্টির সাথে আছে সিপিএম।
নোটকাণ্ড নিয়ে ক্ষুব্ধ মমতা তো কবিতাই লিখে ফেলেছেন। তার সাথে সুর মিলিয়েছে সিপিএম। শুধু সুর মেলানো নয়, নোট নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শরিক হতে নিজেই ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী।
সাধারণ মানুষের এই দুর্ভোগের মধ্যে রাহুল নিজে ব্যাংকে গিয়ে সংবাদ শিরোনামে আসারই চেষ্টা করেছেন বলে মনে করছে বিরোধীরা। ব্যাংকে দাঁড়িয়েই নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ্য করে রাহুল বলেন, ‘কোনও স্যুট-বুট পরা লোক দেখছেন লাইনে? কোনও এক জন কোটিপতিকেও কি দেখা যাচ্ছে? গরিব মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তাই তাদের পাশে দাঁড়াতে আমি লাইনে দাঁড়িয়েছি।’
এর আগেও মোদির সরকারকে বারবারই ‘স্যুট বুট কি সরকার’ বলে খোঁচা দিয়ে এসেছেন রাহুল। পাশাপাশি, রাহুল যেমন মোদী সরকারকে বড়লোকের সরকার বলে থাকেন, মোদীরাও রাহুলকে শাহজাদা বলে কটাক্ষ করেন।
উল্টো দিকে বিরোধীদের দাবি, পুরোটাই রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা। রাহুল ব্যাংকে গিয়ে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়িয়েছেন। বিজেপি মুখপাত্র জি ভি এল নরসিংহ রাও বলেন, ‘রাহুল সভা করে ভিড় জোটাতে পারেন না, তাই এখন ভিড় দেখে নিজেই ছুটে যাচ্ছেন।’
রাহুলের অভিযোগের উত্তর দিয়েছে বিজেপিও। এক বিবৃতিতে হয়েছে, ‘যারা চিরকাল বংশগর্বের সুযোগ নিয়ে এসেছেন, তারা তো কোনও দিন লাইনে দাঁড়াননি আগে। রাহুল যদি নিজের দলে লাইন দিতেন, প্রথম স্থানাধিকারীকে যদি দলের দায়িত্ব দেওয়া হতো, দলটার ভাল হতো।’
এছাড়া মোদীর নোট সংস্কার যে ধনী-গরিবকে একসঙ্গে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে, সেটাই সরকারের সাফল্য বলে দাবি করছে বিজেপি। আর দলের সভাপতি অমিত শাহ এ দিন কংগ্রেস, সপা, বসপা এবং আপ সকলেই বিরোধিতার জন্য সমালোচনা করেন।
টাকা বদলাতে না পারায় গ্রাহকদের হাত প্রায় ফাঁকা। যার প্রভাব পড়েছে ভারতের সমস্ত বাজারে। ব্যবসায়িক লেনদেন প্রায় বন্ধ ছিল। মুদি, স্টেশনারি, শপিংমল থেকে শুরু করে মাছের বাজার পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ভোগান্তিতে ক্ষুব্ধরা পাইকারি ও খুচলা বিক্রেতাসহ ভ্যানচালক এবং হেলপাররা বন্ধ পালনের ডাক দিয়েছে।
আগামী বছরই চার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে এই নোট বাতিলে চরম বিপাকে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নিজেদের কালো টাকা সাদা করতে এবার হয়তো ভোটারদের ঘুষ দেবে রাজনৈতিক দলগুলো। ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, গোয়া, উত্তরাখণ্ডে ভোট। তাই বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলো নগদ জমার কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদির এই পদক্ষেপে স্বাভাবিকভাবেই প্যাচে তারা।
ভারতের বাজারে যেখানে সবক্ষেত্র মিলে নগদ টাকায় লেনদেন হয় ৯০ শতাংশ। সেখানে সরকারের এমন সিদ্ধানে দুদিনে লেদলেন ১০ শতাংশ কমে গেছে।
টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় পোস্ট অফিসও। পোস্ট অফিস কর্তৃপক্ষের দাবি, স্টেট ব্যাংক তাদের যথেষ্ট টাকার জোগান দিতে পারেনি। যা মিলেছে, চাহিদ
নোট বাতিলের ঘোষণার পরই ভারতের বড় শহরগুলিতে গয়নার দোকানে বিক্রির মাত্রা এক লাফে অনেকটা বেড়ে যায়। পাল্লা দিয়ে বাড়ে সোনার দামও। কিন্তু তাতেও কেনাকাটায় ভাটা পড়েনি। ফলে কালো টাকা কী ভাবে সাদা করা যায় সেই ভাবনায় অনেকেই কাতর ছিলেন। যার কারণে গয়নার দোকান বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। প্রাথমিক ভাবে দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা, চেন্নাই, আমদাবাদ, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, ভোপাল, বিজয়ওয়াড়া, নাসিক, লখনউয়ে বড় গয়নার দোকানগুলিকে এই নোটিস পাঠানো হয়েছে। ধীরে ধীরে অন্য শহরগুলোতেও এই নোটিস পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
নোট বদলের ধাক্কা লেগেছ ভারতে বেড়াতে যাওয়া পর্যটক ও চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগী ও তাদের আত্বীয়-স্বজনের ওপর। পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বে তাদের ভুগতে হচ্ছে অর্থসঙ্কটে। এটিএম বন্ধ থাকায় বিপাকে পর্যটকরা।
নোট বাতিল হয়ে যাওয়ায় ভারতজুড়ে ছোট ব্যবসায়ীরা প্রবল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু, যৌনকর্মীরা এই বাতিল হয়ে যাওয়া টাকা গ্রহণ করেই অভুতপূর্ব ব্যবসা করছে।
পশ্চিমবঙ্গের সোনাগাছির যৌনপল্লীর ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’র পক্ষ জানানো হয়, যেসব যৌনকর্মীরা ৫০০ বা ১০০০ টাকা নিয়ে থাকেন তারা সেই অর্থে কোনও সমস্যার সম্মুখীন হননি। তারা দিনভর ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু যে যৌমকর্মীরা সাধারণত ৩০০ বা ৪০০ টাকা নেন তারাই সমস্যা মুখে পড়েছিলেন প্রবলভাবে। কারণ, তাদের কাছে আগত কাস্টমারদের সংখ্যা অন্যান্য দিনের তুলনায় শেষ তিন-চারদিন ছিল অনেক কম।
‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’র পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, তাদের অধীনে রেজিস্ট্রি করা প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার যৌনকর্মী রয়েছে। সম্ভাব্য কাস্টমারেরা প্রথমেই এসে জানতে চাইছেন যে যৌনকর্মীরা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট নিচ্ছেন কি না।
এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, গত দু‘দিনে যৌনকর্মীরা ব্যাংকে ৫৫ লাখ টাকা জমা করেছেন।
শুধু ভারত নয়, নোট নিষিদ্ধের প্রভাব পড়েছে সীমান্তের বাইরেও। ভারতে দু’টি নোট বাতিলের জেরে রাতারাতি বন্ধ করে দিতে হয়েছে প্রতিবেশী দেশ নেপালের দু’টি ক্যাসিনো। নোট বাতিলের জেরে ভারত-নেপাল সীমান্তে অবাধ বাণিজ্য এখন প্রায় থমকে গেছে।