চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

নূর হোসেন স্লোগানে, বিবিধ আয়োজনে

সময়টা ৩২ বছর আগের। দূরন্ত যুবকের বুকে-পিঠে লেখা স্লোগান, না স্লোগান নয় দাবি ‘স্বৈরচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। তারপর উদ্ধত স্টেনগানের গুলি ঝাঁঝরা হয়ে যায় বুক-পিঠ। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ শব্দ-বাক্য ভেদ করে সে গুলি,আঁচ লাগে পিঠে-শরীরে, জীবনে। ঝরে যায় মুক্ত সেই প্রাণ। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্লোগানধারী যুবকের দেহ। স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু রক্তের স্বাদ নেয়। গণতন্ত্র লুটিয়ে পড়ে মাটিতে; আর সেই মাটির তীব্র বিমূর্ত ঝাঁকুনিতে কেঁপে ওঠে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। এক যুবকের একটা স্লোগানে দীর্ঘ জঙ ধরা সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তুমুল প্রভাব ফেলে, এবং এর মাধ্যমে অথবা এর ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচারের কাল গত হয়। ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ সে স্লোগান বাস্তবতায় রূপলাভ হয় বাংলাদেশে। স্বৈরাচারের নিপাত, গণতন্ত্র মুক্তিপ্রাপ্ত হয়, যদিও সেটা ব্যক্তিক নিপাত আর সাময়িক প্রতিষ্ঠানের।

নূর হোসেন নাই, নূর হোসেন মারা গেলেন সেদিন। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্যে তার সে আকুতি মরে যায়নি। গণতন্ত্রের মুক্তির যে বারুদ নীল দীপ্ত স্লোগান আর সকল মানুষের মাঝে সঞ্চারিত হয়। একটা সময়ে সেই পথ ধরে আরও লক্ষ লোক হাঁটা ধরলে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। দেশ মুক্ত হয় স্বৈরাচারের কবল থেকে। নূর হোসেনের সেই স্লোগান আর মৃত্যুর তারিখ ১০ নভেম্বর এবং এর ৩ বছর ২৬ দিনের মাথায় পতন হয় এরশাদের।

এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশ হাঁটা ধরে গণতন্ত্রের পথে, কাগজে-কলমে। প্রাতিষ্ঠানিক সেই স্বীকৃতির পর আমরা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে পেরেছি কিনা এটা বিতর্কসাপেক্ষ; তবে সেই স্বীকৃতি আছে। এখন শাসকেরা গণতান্ত্রিক না হলেও মুখে গণতন্ত্রের কথা বলতেও বাধ্য হচ্ছে। বিরোধীরা গণতন্ত্র নাই বললেও সেই গণতন্ত্রের পথ ধরেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছে। অপ্রাপ্তির নুড়িকণা না খুঁজে এ দিকটা ভাবলে এও কম কীসে!

নূর হোসেনের গণতন্ত্রের জন্যে আত্মবলিদানের বয়স এখন ৩২। যার কবল থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে নূর হোসেনকে জীবন দিতে হয়েছে সেই এরশাদের দল ক্ষমতায় নেই গত ২৯ বছর। স্বৈরশাসকের সেই এরশাদের মৃত্যুও হয়েছে, তবে মরে যাওয়ার সময়ে মুক্ত বাতাস ছিল তার। রাষ্ট্রপ্রধান-সরকারপ্রধানের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সম্মানও পেয়েছেন। জাতীয় সংসদেও শোকের বাণী রেকর্ড হয়েছে। স্বৈরশাসনের পতনের দাবিতে যারা রাস্তায় মার খেয়েছেন, গ্রেপ্তার-নির্যাতনের ভয়ে যাদের কেটেছে রাজনৈতিক জীবন তাদেরও শোকের বার্তা দেখেছে দেশ। মৃত্যুতে সাফ যেন হয়েছিল তার সমূহ অপরাধ। এটা নূর হোসেনের রক্তের প্রতি, নূর হোসেনের চেতনার প্রতি আমাদের অমর্যাদা কিনা, প্রশ্ন রয়ে যায়।

গণতন্ত্রের মুক্তির জন্যে স্বৈরাচারের উদ্ধত স্টেনগানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণ হারানো নূর হোসেন গত আড়াই দশকে কেবল দিবসী আয়োজনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তার মৃত্যুদিন এলে আমরা স্মরণ করি তাকে। রাজনৈতিক দলগুলোও স্মরণ করে তাকে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার এক সাইনবোর্ড ছিলেন তিনি সে কথা বলে সকলেই। কিন্তু আচার-আচরণে তার প্রতিষ্ঠায় যায় না, ভুলে যায়; সচেতন কিংবা অচেতনভাবে।

নূর হোসেন মরে গিয়ে দেশের গণতন্ত্রের পথ রচনা করে গেলেও স্বৈরাচারের চিরস্থায়ী পতন হয়নি। এমনকি স্বৈরাচার এরশাদের দল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল। নিজেও তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ দূত’ ছিলেন। মন্ত্রীর পদমর্যাদার বাইরে এরশাদের জন্যে ছিল অফিস কক্ষ, বিদেশ ভ্রমণ, ভ্রমণের জন্য বিশেষ ভাতা, ইনস্যুরেন্স, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন ১১ জন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারী। দেশ বিদেশে যোগাযোগের জন্য তার বাসা ও অফিসের টিএন্ডটি ফোনের এবং ব্যক্তিগত মোবাইলেরও বিল দিয়েছিল সরকার। ছিল সার্বক্ষণিক গাড়ি। তার জন্যে ছিল সরকারি বাড়ি নেওয়ার সুযোগ, তিনি নিয়েছেন বাড়িভাড়া আর রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ভাতা। এরই সঙ্গে জীবিতকালে এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে পুলিশ প্রোটোকলও ছিল। অর্থাৎ সরাসরি ক্ষমতায় না থাকলেও ছিলেন ক্ষমতার আবর্তে, সুবিধায়। একই সঙ্গে দৃশ্যের বাইরে থেকেও নিয়ন্ত্রণ করেছেন ক্ষমতার রাজনীতি, এমনকি দেশের রাজনীতিও।

অন্যদিকে নূর হোসেন আজ কোথায়? কী প্রাপ্তি তার? দিবসী আয়োজনের পুষ্পমাল্যে, আলোচনা সভা আর গদ্য-কবিতায়! রাজধানীর গুলিস্তানের নূর হোসেন স্কয়ারে! এর বাইরে আর কোথায় নূর হোসেন? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তার সেই দীপ্ত শপথ, স্লোগান, রক্ত, জীবন্ত পোস্টার, আত্মবলিদান- সব কি আজ যাদুঘরে পোশাকি মর্যাদায় আসীন?

নূর হোসেনের স্মৃতিরক্ষার্থে দিনটিকে প্রথমে ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলেও আওয়ামী লীগ এটিকে ‘শহীদ নূর হোসেন দিবস’ হিসেবে নামকরণের প্রস্তাব করে এবং এই নামটি এখন পর্যন্ত বহাল রয়েছে। যে এরশাদ সরকারের গুলিতে নূর হোসেন মারা যান সেই এরশাদের দলও তার মৃত্যুর দিনটি পালন করে এসেছে। এরশাদের দলের কাছেও ১০ নভেম্বর দিনটি ‘গণতন্ত্র দিবস’। যে সরকারের গুলিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাইনবোর্ড নূর হোসেনকে প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের কাছে এই দিনটিকে ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন করাটা একদিকে যেমন নির্মম রসিকতা আবার অন্যদিকটা ভাবলে সে সময়টা যে স্বৈরাচার কাল ছিল সেটার স্বীকারোক্তিও। এর বাইরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় সংসদে নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। শত অপ্রাপ্তির ভিড়ে এটা কিছুটা অর্জনও!

নূর হোসেন যেদিন মারা যান, সেদিন তিনি ছাব্বিশের টগবগে যুবক। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামের অটোরিকশা চালক মুজিবুর রহমানের সন্তান তিনি। ঢাকায় আসেন তারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল নূর হোসেন লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারেন নি; মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন তিনি। ক্লাস এইট পাস এই যুবক দেশের গণতন্ত্রের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন এবং তার সেই আত্মদান আরও একবার প্রমাণ করে এই দেশের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতা যুদ্ধ, গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রামে এদেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের সর্বজনীন অংশগ্রহণ।

আমাদের বাংলাদেশ, আমাদের গণতন্ত্র তাই সকল শ্রেণিপেশার মানুষের আত্মদানের ফল। এই দেশটা তার জন্মপূর্ব সময় থেকে শুরু করে জন্মকাল এবং গণতন্ত্রের উত্তরণের সকল সময়ে সকলের আত্মোৎসর্গে মহান হয়েছে। তাই এই দেশ, এই গণতন্ত্রে লেগে আছে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত সকলের শ্রম, ঘাম, আর রক্ত।

যে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে এমন অগণন মানুষের শ্রম, ঘাম আর রক্ত জড়িয়ে সে দেশে নূর হোসেন যদি দিবসী আয়োজনের প্রতীকী পোস্টার আর তার দাবি প্রতিষ্ঠা না পেয়ে যাদুঘরে স্থান পেয়ে যায়, তবে সেটা হবে আমাদের বড় পরাজয়। আমরা নিশ্চয় নিজেদের এভাবে পরাজিতের কাতারে দেখতে রাজি নই!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)