চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নিজের সঙ্গে নিজের কথা

এক

অনেককাল আগেকার কথা। ঘটনাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বায়ান্ন দিনের ব্যবধানে বাবা-মা মারা গেল, চাচাদের সত্যিকারের চেহারা অমানুষদের মতো উন্মোচিত হয়ে গেলে দুঃসময় তো মাথার ওপর শামিয়ানা টাঙাবেই। আমাদের মাথার ওপর তখন বিশাল ঝলমলে শামিয়ানার আকাশ।

আজিমপুর কলোনিতে নানির দুই রুমের বাসায় আমাদের ছয়ভাই, এক বোনের আশ্রয় মিলল। মামা খালাদের বিশাল সংসারে আমরা এতোগুলো ভাইবোন দিশেহারা হয়ে গেলাম। আমাদের মনটা গুটিয়ে থাকত। কলোনির বাসায় এসে আমরা ভেতরে ভেতরে বসুবাজার লেনে আমাদের তিন রুমের বড় বাড়ির স্মৃতি খুঁজি। বাড়ির সামনে রাস্তা লাগোয়া বারান্দা খুঁজি। ফেলে আসা বন্ধুবান্ধব, মহল্লার আড্ডা- বিকেল হলে বল খেলতে যাওয়া ধুপখোলা মাঠের উদারতা খুঁজি। কিছুই পাই না খুঁজে।

তারপর একসময় আমাদের কয়েক ভাইকে আশ্রয়ের জন্য আলাদা হয়ে যেতে হয়। ইচ্ছের বিরুদ্ধে আলাদা হই আমরা। আমার ছোট দুই ভাইয়ের আশ্রয় মেলে শহর থেকে অনেক দূরের গ্রামে দুই ফুফুর বাড়ি। সেখানে গ্রামের এক প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয় তাদের।

একাশি সালের কোরবানির ঈদে আমি সেই গ্রামে গিয়েছিলাম বড় ভাইয়ের সঙ্গে। ফুফুর বাড়ি যেতে যেতে রাত হয়ে গিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে খুব বৃষ্টি ছিল। দুপুরের পর গুলিস্তান থেকে বিআরটিসি বাসে নরসিংদী। সেখান থেকে মুড়ির টিনের গাড়িতে করে মনোহরদি নেমে সেখান থেকে রিকশায় করে ভাইয়ের সঙ্গে যাচ্ছি তো যাচ্ছি রাস্তা আর শেষ হয় না।

ক্লাস সিক্সে পড়া সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান দেখা আমার কাছে মনে হয়েছে এতটা পথ রিকশায় না গিয়ে লি মেজরস-এর মতো দ্রুত দৌড়ে গেলেই ভালো হতো। সময় যেত বেঁচে আর ভাই দু’টোকেও দেখতে পেতাম তাড়াতাড়ি। আমি ভাবলেই কি আর সব হবে!

আমিসহ আমার ছোট দুই ভাই আশ্রয় পেয়েছি আমাদের নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে। ওদের সঙ্গে আমার পার্থক্য একটাই ওরা জঙ্গলের মতো গ্রামে আর আমি ঢাকায়।

আমরা যখন সন্ধ্যা রাত পেরিয়ে রাতের ঘন অন্ধকার বয়ে নিয়ে বড় ফুফুর বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম ততক্ষণে আমার ছোট ভাইটি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। আহারে, অতটুকু ভাই আমার কতক্ষণ আর আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে! ওর বুঝি ঘুম পায় না?

আমার আরেক ছোট ভাই থাকত পাশের গ্রামে আরেক ফুফুর বাড়ি। তাকে দেখতে যাব পরদিন।

সেই রাতে আমি ভাত খেলাম না। নিজের সঙ্গে নিজের একটা রাগ পুষে রাখলাম। সবার অগোচরে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি অনাদরে, আলুথালু গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা আমার ছোট ভাইটির মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলাম। অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মধ্যে হঠাৎ যেন কোত্থেকে একটা শির শির করে কাঁপন ধরে উঠেছিল।

কেন যে সেদিন আমি আমার ভাইটির দিকে অমন করে তাকিয়ে ছিলাম বলতে পারব না।

সেই রাতে আমার ভাইটির ঘুম ঘুম চেহারা দেখতে দেখতে আমার সামনে আমার কতকাল আগে মারা যাওয়া বাবা-মার ছবি ভেসে উঠল আর মনে পড়ে গেল, আরে! এই ভাইটি তো আমার বাবা-মার খুব আদরের ছিল। খুব আদরের ছিল…