চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

নাসিরনগরেও রামুর ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষজন আক্রান্ত হয়েছে, মাধবপুর ও ছাতকে একই ঘটনা ঘটেছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষজন বলাই সঙ্গত কারণ যারা আক্রোশের শিকার হয়েছে তারা সকলেই হিন্দু ধর্ম পালন করে অথবা জন্মসূত্রে ওই ধর্মের, আর যারা আক্রমণ করেছে তাদের সকলেই ধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আক্রান্ত আর আক্রমণকারী উভয়ের এমন অবস্থার পেছনে মূল কারণ ধর্ম। এটা ‘সহীহ ধর্ম’ পালন কিনা সেটা অনন্ত তর্কসাপেক্ষ বিষয়, সমাধানে পৌঁছার সম্ভাবনাও তাই ক্ষীণ।

নাসিরনগরে হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ, লুট আর ভাঙচুরের রেশ ধরে পার্শ্ববর্তী এলাকা হবিগঞ্জের মাধবপুরে একই ঘটনা ঘটিয়েছে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা। ফেসবুকে এক ছবি পোস্ট করাকে কেন্দ্র এ ঘটনার সূত্রপাত বলে জানিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। রসরাজ দাস নামের এক যুবক ফেসবুকে কাবা ঘরের উপরে এক হিন্দু দেবতার ছবি বসিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছে এটাই অভিযোগ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে পুলিশ রসরাজকে গ্রেপ্তার করে। তবে অভিযুক্ত যুবক রসরাজ ফেসবুকে এক পোস্ট করে জানিয়েছেন, তিনি এমন কিছু পোস্ট করেন নি, অন্য কেউ তার হয়ে এমন করেছে। তার দাবি মতে কেউ তার আইডি হ্যাক করেছে। হ্যাকিংয়ের সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে ওই পোস্টে রসরাজ হিন্দু-মুসলমানদের সহাবস্থানের বর্ণনা দিয়ে তার পক্ষে এমন পোস্ট দেওয়া অসম্ভব বলেও দাবি করেন।

রসরাজ দাসের ফেসবুক হ্যাক করে কেউ এমন পোস্ট করেছিল কিনা সেটা তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। তার দাবির সত্যতা থাকলে বিচারে সে নির্দোষ প্রমাণ হবে। সে নিজে এমন পোস্ট না করলে অন্য কেউ নিশ্চিতভাবেই করেছে, তবে সে কে- এটাও বের করা জরুরি।

ওই যুবকের সে ফেসবুক স্ট্যাটাস ক’জন মানুষ দেখেছে জানি না, তবে অতি-প্রচারের কারণে কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে অনেক লোকের। এ ধর্মীয় অনুভূতি কারা উসকে দিলো- এটা বের করা জরুরি। জানা গেছে, স্থানীয় ‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ নামের উগ্র ইসলাম ধর্মীয় সংগঠনগুলো এ নিয়ে শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছে। সমাবেশে আগত মানুষদের উসকে দিয়েছে আক্রমণে এবং এরপর সকলকে নিয়ে আক্রমণ করেছে হিন্দু মন্দির, বাড়িঘরে এবং সেখানে লুটপাটও হয়েছে। ফলে ধরা নেওয়া যায় এ আক্রমণ হুট করে সম্পাদিত হয় নি। এর পেছনে ছিল পরিকল্পনা ও লোক জড়ো করে হামলার পূর্বপ্রস্তুতিও। mondir

এ হামলার পর আক্রান্ত অনেকেই অভিযোগ করেছেন আক্রমণের সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। পুলিশ কেন এমন ভূমিকা নিলো? স্বভাবত প্রশ্ন জাগে তাহলে পুলিশ কী ভয় পেয়েছিল কোনো? উন্মত্ত, ধ্বংসকামী সে সব মুসলমানদের প্রতিহত করতে তারা কি প্রস্তুত ছিল না। যদি সে সময় তারা প্রস্তুত না থাকত তাহলে প্রশাসন কেন প্রস্তুতি নিলো না!  এর দায় কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়।

এ তো গেলো হামলার সময়কার পরিস্থিতি। হামলার আগের ঘটনার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, এ ইস্যুতে উগ্র ধর্মীয় সংগঠন আহলে সুন্নাত ও হেফাজতে ইসলাম অনুমতি পেল সমাবেশের কিন্তু কেন থাকল না কোন নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য? এটা কি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়? এতবড় ঘটনার পর পুলিশ-র‍্যাব ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। পুলিশ-র‍্যাব ঘটনার সাথে সাথে সক্রিয় হলে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা এত সাহস দেখাতে পারত না।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্য অনুযায়ী ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ ওয়াহাবী মতাদর্শের বিরোধী, একই কথা প্রযোজ্য ‘হেফাজতে ইসলামের’ ক্ষেত্রেও; বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটা জামায়াতে ইসলামীর মতাদর্শ পরিপন্থী। ঠিক এ প্রচারণাকেই কাজে লাগিয়ে তারা ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগ ও সরকারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। ফলে ধারণা করা যায় রাজনৈতিক সম্পর্কের এ বিষয়টি কাজে লাগিয়ে তারা খুব সহজেই সমাবেশের অনুমতি নিতে পেরেছে, অথবা অনুমতি ছাড়াই বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল করতে পেরেছে এবং সে সমাবেশকে ঘিরে গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের নজরদারি ছিল না। যদিও আহলে সুন্নাতের সমাবেশে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম মুনিরুজ্জামান সরকার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন ও ওসি আবদুল কাদের উপস্থিত ছিলেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে তাহলে কীভাবে এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল? কিছুটা হলেও দায় কি তাদের নয়?

ফেসবুকে রসরাজ নামের যুবক শুক্রবার পোস্ট করেছিলেন, ওই দিনই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু শত শত লোক সভা-সমাবেশ, মিছিল করে মন্দির ও বাড়িঘর লুট করে রোববার। ফলে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ হামলা, ভাঙচুর ও লুটের পেছনে ছিল দীর্ঘ পরিকল্পনা। ঘটনার দুই দিন পর যেখানে এত বড় জনসমাগমের প্রস্তুতি নিয়ে হামলা চালানো হয় সেখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করছিল, প্রশাসনই কেন নিলো না পূর্বপ্রস্তুতি? কারণ এ জনসমাগম গোপন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আয়োজন হয় নি, সবকিছু ছিল প্রকাশ্য ও ঘোষিত।

এদিকে, নাসিরনগরের এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে দলটি নাসিরনগরের ইউএনও ও ওসির অপসারণ দাবি করেছে। আওয়ামী লীগের দাবি এতগুলো মন্দিরে হামলা হলো; অথচ প্রশাসন কিছু করতে পারল না। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিলে এ হামলা ঠেকানো যেত। আওয়ামী লীগের এমন দাবি যে লোক দেখানো তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ সরকারদলীয় এ দলটিই বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একমাত্র নির্বিঘ্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে। সবখানে আওয়ামী লীগ, কিন্তু হামলা-ভাঙচুর-লুটের পর এসে তারা অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেদের ভোটব্যাংক অক্ষুণ্ণ রাখতে মরিয়া। এটা দুঃখজনক যে, বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রথম রাজনৈতিক পছন্দ যেখানে আওয়ামী লীগ সেখানে আওয়ামী লীগ ওই ধর্মাবলম্বী মানুষদের নিরাপত্তায় কোন ভূমিকাই রাখতে পারে না, অথবা রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না।

mondir2নাসিরনগরের সে ঘটনার জের ধরে পাশাপাশি এলাকা হবিগঞ্জের মাধবপুরেও একইভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, মন্দির ভাঙচুর ও লুট হয়েছে। এখানেও পুলিশের কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ছিল না। ঠিক কাছের এলাকায় এতবড় এক ঘটনার পর কেন পুলিশ এখানে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় সেটা প্রশ্নের জন্ম দেয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ, ভাঙচুর, লুট এটা মুসলমানদের অনেকেরই মধ্যে সংক্রামক হয়ে দেখা দিয়েছে। কোথাও এমন কোন ঘটনা ঘটলে অন্য জায়গার কিছু মানুষ আরও বেশি উৎসাহ পায়। আর এ উৎসাহের পালে হাওয়া যোগায় অপরাধীদের অপরাধ করেও পারে পেয়ে যাওয়ার ইতিহাস, তা যখন ধর্মের নামে।

নাসিরনগর ও মাধবপুরের নারকীয় ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলার আসামীরা অজ্ঞাত। অথচ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের পর অথবা মিছিলের মাধ্যমে এ হামলা সম্পাদিত হয়। গণমাধ্যমে কল্যাণে সারাদেশ দেখেছে উন্মত্ত মিছিল ও সমাবেশের ছবি কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে পুলিশ এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সমাবেশ, মিছিলের আয়োজক ও উস্কানিদাতাদের পরিচয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে সকলেই জানে কিন্তু পুলিশ জানতে চায় না, অথবা জানলেও প্রকাশ করতে চায় না। এখানেই আদতে অপরাপর অপরাধীদের প্রতি এ বার্তা দেওয়া হচ্ছে ধর্মের নামে অপরাধ করলেও জাস্টিফাই সম্ভব!

পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয় সহস্রাধিক লোককে আসামি করেছে, এতে মামলার পরিণতি সুখকর হওয়ার কথা নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের উস্কানিদাতা নেতাদের পুলিশ চেনে না এটা মনে করার কোন কারণ নাই। পুলিশ চেনে তাদের, কিন্তু তাদেরকে উল্লেখ করার ও ধরার সাহস পাচ্ছে না। পুলিশ কেন সাহস করছে না, এ প্রশ্নের উত্তর একটাই রাজনৈতিক প্রভাব ও সিদ্ধান্ত। পুলিশের একার পক্ষে কি এ প্রভাব ও সিদ্ধান্তের বিপরীতে কোনোকিছু সম্ভব? মোটেই না!

তাই ওসব হামলার পরিণতি মামলা পর্যন্তই। সঠিক চার্জশিটের সাহস হয়ত প্রশাসনের নাই। আর সঠিক চার্জশিট না হলে বিচারের আশাও কমে আসে। এখানে বিচার বিভাগের দোষ নাই। বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পাদনের প্রাথমিক পদক্ষেপ যেখানে সঠিক চার্জশিট সেখানে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলে তাদের পক্ষে সঠিক বিচার কতখানি সম্ভব?

প্রশাসন সঠিক চার্জশিট দিতে পারবে যদি তারা সরকারি ও সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা পায়। কিন্তু সেটা পাওয়া কঠিন, সে ত ইতিহাসই বলে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে, হামলা, ভাঙচুর করছে তাদের সকলেই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট। সেক্ষেত্রে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ মানে এক শ্রেণির মানুষের অপপ্রচার; তাই রাজনীতিবিদরা এখানে ধর্ম খুঁজে, এ ধর্ম তার নিজের ধর্ম, নিজেদের ধর্ম; আর অতি অবশ্যই রাষ্ট্রের ধর্ম! এখানেই আমরা হেরে যাই; বারবার হেরে যাই! এটাকে নিয়তি বলা যাবে না, দুর্গতি বলাই সঙ্গত!

নাসিরনগর ও মাধবপুরে যে ঘটনা ঘটল সেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নজিরবিহীন কিছু নয়, এটা অহরহই ঘটছে; এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ধর্মের নামে এমন ঘটনাগুলো ভবিষ্যতেও ঘটবে। এ থেকে উত্তরণের পথ কী- ভাবা দরকার। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সঠিক ও দৃঢ় পদক্ষেপই পারে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে। কক্সবাজারের রামু ঘটনার পর একইভাবে সকলেই বলেছিল এর পুনরাবৃত্তি এড়াতে হবে, কিন্তু নাসিরনগর ও মাধবপুরের ঘটনার পর বলা যায় এখনও সে রকম রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি সরকার ও প্রশাসন। রামুর বৌদ্ধ উপসনালয়ের ছবি ফিরে আসে নাসিরনগরে। একজনের কথিত ও কৃত এক ফেসবুকে আক্রান্ত হয় শত-শত!

দেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা, মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট সত্ত্বেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে অদ্যকার নাসিরনগর কিংবা মাধবপুর বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। ওসব জায়গায়ও সরকার-প্রশাসন সব আছে। তাই সরকার ও প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে, তা না হলে মানুষের মনে এ ধারনা বদ্ধমূল হবে মন্দিরে আক্রমণ, ভাঙচুর ও লুটের ঘটনায় তাদের প্রকাশ্য সহযোগিতা না থাকলেও প্রতিহতকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে বড় ধরনের অনীহা তাদের!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)