নারী অগ্রযাত্রার পথ এখন প্রশস্ত। কোনো কাজে নারী পিছিয়ে নেই। সংকীর্ণ নয় নারীর চলার, বলার পথ। গলি-ঘুপচি ডিঙ্গিয়ে বিশ্বায়নের এ সময়ে নারী মহাসড়কের পথিক। নারী অন্ধকারে নয়, এখন নারীর হাত ধরেই প্রস্ফুটিত হচ্ছে আলোক রশ্মি। কোন কাজে নারী নেই, সকল যাত্রায় নারীর পদধূলি অঙ্কিত করছে হরেক ছবি। জেট-বিমানের চালক থেকে শুরু করে মাঠের আধুনিক কৃষাণীর কাজেও নারী। শিল্পের মজুর থেকে মালিকও নারী। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে সমালোচকও নারী। বিশ্ব নেতৃত্বের আসনেও নারীর উপস্থিতি কম নয়। এই বিংশ শতকের এমন একটি ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীর হস্তছাপ নেই চিন্তিত চেতনে। কলে-কারখানায়, জাহাজে-জঙ্গলে, ভূমিতে আকাশে নারী হাঁটছে নিজের জ্ঞানে, ধ্যানে, যোগ্যতায়। নারীকে পেছনের সারির ভাবার কোনো কারণ আর এখন নেই। নারীই নারীকে তুলে ধরেছে সুউচ্চে।
প্রাগৈতিহাসিক কালের বা মধ্যযুগের অথবা এই তো সেদিনের দিন বদলিয়েছে। নারীকে যারা অবলা ভাবতো তারাই সবল বলে নিজের আসনটি ছেড়ে দিয়ে বসছেন পাশের আসনে। শ্রদ্ধায় সম্মানে প্রস্তাব করছেন মন-বিমত। তুড়িতে উড়িয়ে দেয়ার সময় গেছে ফুরিয়ে। বরং তালুতে তুলে রাখার দিন চলছে এখন। করুণা নয়, অধিকারই অধিকারকে বলিষ্ঠ করে নারীকে নিয়ে এসেছে সামনে। নারীর আসনকে করেছে পোক্ত। নারীকে দেখিয়েছে দিকের আলো। উদার করেছে জানার শোনার বলার দৃষ্টিভঙ্গি। কালের জীর্ণ বালি গা থেকে ঝেরে নারী সফেদ যৌক্তিকতায় অযৌক্তিক সিঁড়ি টপকে এসেছে সামনে।
সামনে হলেও সে সামনে দক্ষিণ এশিয়ার আমাদের এ দেশে কতটুকু? নগরের আদালতে বিচারের চোখ দিয়ে দেখলে আলো যতটা ফকফকা, শহরের পাশে শহরতলীতে আলো ততটা উজ্জ্বল নয়। ঘন আঁধার বলা না গেলেও আলো যে ঝাপসা তা বলা যায় নির্দ্বিধায়। শহরের কথাই যদি তুলি, এই শহরের কতজন নারী জানেন নারীর অধিকারগুলো? কতজন নারী জানেন আইনের সবটুকু? কতজন নারী নারীর প্রাপ্য অধিকারে সচেতন? একটি দুটি বিশেষ ক্ষেত্রে বিচরণরত নারী ব্যতিত ঠিক এই শহরের কেন্দ্রস্থলের অনেকেই তো অজ্ঞ আর অন্ধত্বতার মেঘভিড়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখছেন সময়ের এই সময়েও। যে নারী, নারী অধিকার বলে সভায় সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছেন তিনিও কি অধিকারের সর্ববিধান জানছেন? জানাচ্ছেন? এমন নারীর সংখ্যা হাতে গুনলে এই রাজধানীতে নগন্য একটি সংখ্যার বেশি পাওয়া কঠিন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় নারী-অধিকার বঞ্চিত, লাঞ্ছিত নানান আয়োজনের দিকে চোখ রাখলেই। খোদ শহরেই নারী সচেতনা আসেনি স্রোতের মতো, নালার জলের মতো ধীর গতিতে বাড়ছে ধারা। সমীক্ষায় হয়তো নারীকে পাওয়া যায় পাঁচ আঙুলে, তবে তার উপস্থিতি কতটা বলবার মতো?
নানান পেশায় নারীর সাড়া জাগানো কাজের দক্ষতা দিয়ে নারী সচেতনতার শতাংশ বিচার করা সঠিক হবে কি-না জানি না। শিক্ষা, জ্ঞান, আর সচেতন শব্দত্রয়ের মধ্যে যেমন বিস্তর পার্থক্য রয়েছে উপস্থিতিতেও ফারাক রয়েছে অনেক। উচ্চশিক্ষিত হলে উচ্চ চাকুরি মিলে যায়, উচ্চশিক্ষিত হলে ‘উচ্চসচেতন’ এই শব্দটি বোধ হয় যে কারো সাথে জুড়ে দেয়া যায় না। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই ভুলটি যথাতথাই দেখা যায়। পেশা আর শিক্ষার হারকে নির্দিষ্ট করে সচেতন প্রেণি নির্ধারণ করা হয়। তা কতটুকু ঠিক তা প্রশ্ন?
এসব প্রশ্নকে বাদ দিয়ে আবার সচেতন বলে যারা দাবী করছি তারাও কতটুকু সচেতন? ঘর থেকে দু’পা উঠানে ফেলা হয়েছে মাত্র। নারী কাজের গণ্ডিতে প্রবেশ হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে ও গতিতে। জোয়ার আসছে না তেমন যেমন বর্ষণ হচ্ছে। যে দেশের ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে নারী, তার পরেও নারী, তার পরেও নারী, যে দেশের শিক্ষার, মেধার, জ্ঞানের আসনে বিস্তর নারী সে দেশে, সে সমাজে, সে গৃহ ব্যবস্থায় যেভাবে নারী সচেতনতার বান আসার কথা সেভাবে বান আসছে কি?
নারী সমাজের শ্রদ্ধেয় অনেকে বলছেন, নারীর জন্য ক্ষেত্র তৈরি করা হয়নি! ক্ষেত্র কি কেউ কাউকে তৈরি করে দেয়? তৈরি করা ক্ষেত্রে বিচরণ করাকে কি স্বাধীনতা বা সচেতনতা বলে? কোটা করে করে সচেতন করা যায় কখনো? অগ্রগতির পথে সুযোগ বরাদ্দ করে, পথ তৈরি করে, নির্দিষ্ট আসন বানিয়ে কাউকে কি তুলে আনা যায়? আনা যায় চেয়ারে, টেবিলে, ক্ষমতায়। আত্মজ্ঞানে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত না হলে; ধ্যানে জ্ঞানে সজাগ না হলে; জানায়, বুঝায় তীক্ষ্ণ না হলে; যত যা’ই ঝুড়িতে তুলে দিলে তা কতক্ষণ! যথাপাত্রেই তা বর্ধিত হবে ও সময় পরে মৃত্যু এসে তাকে ধ্বংসে পর্যবসিত করবে। যুগের প্রবাহে প্রবাহিত হবে না। অনেক সময় স্বাধীনতা আসতে পারে, মুক্তি আসবে না।
কোনো নারীর জন্য মোটা অংকের অর্থ উপার্জন, বাণিজ্যে অংশিদার, শিল্পে উত্থান মানেই কি নারী অগ্রগতি? একক সাফল্য কি তার উদাহরণ? সভায় সভায় ঝাঁঝালো কথা কি সচেতনতা? চেতনা মনে মেজাজে মননে বিস্তৃত হলেই না তা সামগ্রিকভাবে সচেতনতা। সচেতনার সাথে চাকুরি, বাণিজ্য, সভা, সেমিনারের কোন যোগসূত্র নেই। অর্থ সচেতনতাকে জোরালো করে। শিক্ষা সচেতনাকে সমৃদ্ধ করে। সে শিক্ষার জায়গায় আমাদের নারীসমাজ হতে পারছে না মজবুত। জানার জায়গায় আমাদের নারী সমাজ হতে পারছে না শক্ত। জানানোর জায়গায় আমাদের নারী সমাজ হতে পারছে না পরিশ্রমী। আমাদের নারী অনেক দূর এগিয়েও পারছেনা উঠে দাঁড়াতে। প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি স্থানে নারী উপস্থিত হলেও তার দ্যুতি যতটা পড়ার কথা ততটা পড়ছে না রাষ্ট্র থেকে সমাজ পেরিয়ে গৃহকোণে।
নগরের দেয়াল ছেড়ে ঢুকতে পারছে না গ্রমে গঞ্জে, অস্তাচল থেকে উঠে আসলেও যেতে পারছে না অস্তাচলে, যেখানে এখনো অন্ধকার উজ্জ্বল। কিঞ্চিত আলোর দেখা পাওয়া যায় বটে তবে তা দৃষ্টান্ত নায়। এহেন থেকেই বুঝা যায় এখনো অন্ধত্বতার বেড়াজাল থেকে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বেড়া থেকে বের হতে ব্যর্থ হচ্ছে নারীর কণ্ঠস্বর। এখনো ধর্মের গোরামী, সামাজিক বিধি-নিষেধ, পারিবারিক নিয়ম, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব মারিয়ে নারীর চেষ্টা ও সাহস উজিয়ে উঠতে বিঘ্নিত হচ্ছে দারুণভাবে। আমরা যখন দেখি কলসিন্দুর থেকে উঠে আসা নারী (কিশোরী) ফুটবলাররা দেশে-বিদেশ চষে বেড়াচ্ছে দাপটের সাথে, জয় করে আসছে স্বর্ণ, রৌপ্য তখন কিন্তু সে গাঁয়ের থেকে উঠে আসছে আরও অনেকে, পাশের গাঁ থেকে মেয়েদেরকে খেলায় দিতে চাচ্ছে আরও পরিবার।
কোনো এক বাড়ির মেয়ে যখন বহু মান-অপমান গায়ে মেখে পৌঁছে যাচ্ছে সাফল্যের শিখরে, তখন কিন্তু পাশের বাড়ির অভিভাবক তার মেয়েকে দিতে আগ্রহী হচ্ছে এই কর্মযজ্ঞে। যে পাড়ার দস্যি মেয়েটি সমাজের বাধ ভেঙ্গে নাম লেখালো থিয়েটারে, যে মেয়েটি অভিনয়ে পারদর্শী হয়ে নাম ফোটাচ্ছে উঁচুতে, সে মেয়েটিকে একদিন যারা অপমান অপবাদ দিয়েছে তারাই কিন্তু আবার তার প্রসংশা করছে। নিজেদের মেয়েকে কোন কাজে দক্ষ করা যায় সে মেয়েটির কাছে পরামর্শ চাচ্ছে। এতে স্পষ্ট বুঝা যায়, আমাদের জানার অভাব। নারী যে পারে, নারীর জন্য যে জায়গা আছে, নারী চাইলে যে যেতে পারে অনেক দূরে সে জ্ঞানই আমাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছেনি নিপুণভাবে। আমরা পৌঁছাতে পারিনি তেমন করে।
আমাদের সামাজিক রাষ্ট্রীয় অবস্থার দেয়াল বড় উঁচু হলেও আকাশ মাটিতে জোড়া দেয়া নিশ্চয় নয়, নিশ্চয় কোথাও না কোথাও ছিদ্র আছে, ফাঁকা আছে, সে ফাঁকা ফোঁকরটি ছিন্ন করে রব তুলতে পারিনি জোরালোভাবে। আদি মত, আদি নিয়ম, আদি রীতি, আদি প্রবাদ, আদি ভয় জেঁকে আছে আমাদের নারী, নারী সমাজ তথা সমাজ পথের পদে পদে। তার ছায়া লেগে আছে পরিবারগুলোর শরীরে তীব্র ভাবে। সে ছায়া ছাড়াতে না পারলে বড় বিলম্ব হবে বিশ্ব অগ্রগতিতে আমাদের নারীর অগ্রগতি যোগ করা।
দেখুন আধুনিক এই সময়ে এই তো সেদিনও নারীর প্রাইভেটাইজেশন চাকরির ক্ষেত্রে শুধু স্কুল শিক্ষক ছাড়া অন্য কোনো পেশাকে নিরাপদ মনে করতো না। এই তো সেদিনও কলে কারখানায় চাকুরিকে নারী ও তার পরিবার অসম্মানের মনে করতো। অথচ আজ নারী বাস ড্রাইভিং করছে, রিক্সা চালাচ্ছে, হকারি করছে এবং সম্মান ও গর্বের সাথে এ কাজের কথা বলতে ও মানতে দ্বিধা করছে না। শর্তে, যুক্তিতে তা কেন অসম্মানের নয় তাও বুঝিয়ে দিচ্ছে চারপাশের স্বজন পরিজনকে। চেতনে এ সচেতনতা এই দ্বিধাহীনতা সর্বস্তরে পৌঁছাতে পারলেই সার্থকতা। এই দ্বিধাহীনতা সর্বস্তরে পৌঁছাতে পারলেই সাফল্য। এ সার্থকতায় যত দেরি তত দেরি সার্বিক উন্নয়নে, মানবিক সমাজ তৈরিতে।
পিছিয়ে পড়া নারী ও পরিবারগুলোকে ম্মরণে রাখতে হবে- কেউ কাউকে পথ তৈরি করে দেবে না, কেউ কাউকে পথ তৈরি করে দেয় না। নারীকেই নারীর জন্য পথ তৈরি করে নিতে হবে। যারা নিয়েছে তাদেরকে কেউ হাতে তুলে দেয়নি। যারা নেবে তাদেরকেও কেউ হাতে তুলে দেবে না। নারীর সাহসেই নারীকে মেধার মননের আওয়াজ তুলতে হবে। আওয়াজ দিতে হবে। ভয়ের দিন শেষ, সাহসেই বিজয় নিশ্চিত হয়। না-হয় সাহস করেই দেখা যাক-না একবার? ভয় তো তাদের জন্য যারা অযোগ্য। ভয় তো তাদের জন্য যারা দুর্বল। নারী চাইলেই অবলা খ্যাতি একটানে ছিঁড়ে সবলা রূপে উদিত হতে পারে ক্ষণিক সময়ে।
নারী যে সবল তার অহরহ প্রমাণ আমাদের হাতের কাছেই আছে- চারপাশে। তবে ভয় কিসে? হাতের পাঁচ আঙুল মুষ্ঠি করতে শিখতে হবে। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে ধরতে শিখতে হবে। প্রাণে আনতে হবে বল। স্বপ্নের চেয়ে বড় সাহস নেই, সাহসের চেয়ে বড় শক্তি নেই। নারীকে সাহস সঞ্চার করতে হবে। অতীত নারী জাগরণে যারা মহিয়ান তারা কেউ কি প্রবল শক্তির উৎস ছিলেন? ছিলেন না। স্বপ্ন আর সাহসের সম্মিলনে তারা হয়ে উঠেছিলেন সাহসী। আজকের নারীও সবলে সাহসী হলে আটকাবে না কোনো অর্জন। বাতাসে ভাসবে না নারীর মলিন মুখোচ্ছবি।
সে মুখোচ্ছবি দেখতে না হলে, খাদ থেকে উঠে আসতে হলে শুধু সবল হয়ে ঘরকোণে নীরবে আত্মউপভোগে নিমগ্ন থাকলে তুষ্টি আসতে পারে আত্ম-আত্মায়, তবে জাগরণ আসবে না। বাহুতে বল নিয়ে বসে থাকলে আত্মউন্নতি হতে পারে- অগ্রগতি সম্ভব নয়। জগৎময় নারী ঘরের কুনো ব্যাঙ নয়, বলিয়ান উচ্চস্বর। নারীর উজ্জ্বল আভা আমাদের দেশেও নৈ:শব্দ নয়। আঁধারে নিমজ্জিত নয়। বিশ্ব নারীর সহাবস্থানের সে ছায়া আমাদের দেশেও কম নয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, নারীর পশ্চাদপদতা, হীনমন্যতা, পরিবারগুলোর অজ্ঞতা, ভয়, হিংসা, ক্ষেত্রের অভাব নারীর যাত্রাপথকে শ্লথ করছে। বাধাগ্রস্থ করছে। প্রচার ও প্রসারের অভাব, আত্মনিমগ্নতার অভ্যাস, এককেন্দ্রিকতার ভার আরও ডুবিয়ে রাখছে। ধর্মীয় ভয়, ধর্মীয় অন্ধতা, মুখে মুখে শুনে ভীত-বিভ্রান্ত হয়ে পড়া, নিজেদের অজ্ঞতা, শিক্ষার অভাব ইত্যাদি কারণে কোণঠাসা হয়ে থাকছে এগিয়ে যাবার সুযোগ সামনে রেখেও।
নারীকে ভাঙ্গতে হবে নারীর মন-ভীতি, অকারণ সংকোচ, সামাজিক কুসংস্কারের আসবাবপত্র। পারিবারিক অতিরঞ্জনের খোলস থেকে নারীকেই বাহির হয়ে বলতে হবে বাহিরের রঙের কথা। অন্ধ পরিবারকে, সমাজকে জানাতে হবে নারীর বাহিরমুখিতার অর্থ কখনো উগ্রতা নয়, অধর্ম নয়, অন্যায় নয়। ধর্মেও শিক্ষার জন্য সুদূর চীন দেশে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে স্পষ্টত। এই শিক্ষা কি শুধু স্কুল কলেজের শিক্ষা, নাকি জ্ঞান? যদি জ্ঞান হয় তবে নারী বা পুরুষের কথা তো আলাদা বলা হয়নি। নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে ভুল ধারণার বিভ্রাটগুলো চিহ্নিত করে নারীকে প্রচারে নামতে হবে। কথায় বলে ‘প্রচারেই প্রসার’। প্রচারেই প্রসার হয়। আজকের যে নারী ধুলিমণ্ডিত পথ পেরিয়ে মেঠো পথ থেকে কাদা-জল ছাড়িয়ে নিজের সাথে যুদ্ধ করে বড় বাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে, জানান দিচ্ছে নিজের কথা তাকে নিজের কথা বলায় আবদ্ধ থাকলে হবে না। সর্বজ্ঞান সর্বশেষে অর্থ উপার্জনে কেন্দ্রিভূত নয়। যুগের কালো ধুলো ধুয়ে মুছে পরিস্কারের দায় ও দায়িত্বের মধ্যে নিহিত রয়েছে জ্ঞানের বিশালতা। নারীকে যে যার জায়গা থেকে সরব না হলে অঙ্কুরিত রবও নীরব হতে সময় লাগবে। নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের সুবিধার্থে মানবিক গৃহ সমাজ রাষ্ট্র গঠনে নারীর সাথে নারীকে বিচরণ করতে হবে সুশৃঙ্খলভাবে। কষ্টে যা অর্জিত সে অর্জন ছড়িয়ে দিয়ে সচেতন করে তুলতে হবে পশ্চাদপদ অধ্যুশিত নারী সমাজকে। প্রতিনিয়ত স্বর, সুর ছুঁড়ে মারতে হবে অনেক দূর সম্মুখে।
স্বর যতই দূরে যাক, সে স্বর সুন্দর গীত হয়ে ফিরে না-ও আসতে পারে। কিছু স্বর ভাঙ্গতে পারে, কিছু স্বর হারিয়ে যেতে পারে, কিছু স্বর নিপতিত হতে পারে পথের পাশে, কিছু স্বর বাজতে পারে সবল হয়ে। বিচ্যুতিতে বিচলিত হবার কিছু নেই। বাধে বিবাধে বিমর্ষ হবার কিছু নেই। হ্রেষা স্বরে এগিয়ে যেতে হবে সব ঝরা বৃক্ষ-পাতা পায়ের তালুতে পিষ্ট করে। পাছে লোকে কিছু বলে অন্তরে ধারণ করলে পেছনের সংশয় ছাড়বে না কোনদিন। ঘা’তে আঘাতে লোহা মজবুত হয়, দৃঢ় হয় বন্ধনে। লোহার মতো ধৈর্য পুষতে হবে ঝড়ের অকূলে যুদ্ধ করতে হলে। নারী অগ্রদূতদের জীবন-ইতিহাস পাঠ করলে এ দৃশ্যই ভাবে দৃষ্টি পৃষ্ঠায়।
বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমামসহ অগ্রদের কথা শুনে যত-না সাহস আসে, পাঠে জানা যায় তাদের সে পথের যুদ্ধ কাহিনী। অতীতের বল কব্জিতে নিয়ে বর্তমানের ব্যবহারে ভবিষ্যতের দিকে হাঁটতে হবে দৃঢ় পায়ে, মনে, মনোবলে। যত বৈরী বাতাসই ঝাপটা মারুক, জলোচ্ছ্বাস উগ্রে উঠুক কূলের উপরে, হাতের হাল ছাড়লেই বিপদ। গুলুই থেকে পড়ে গেলেই বিনাশ। নারীকে ভুলে গেলে হবে না, আজকের সুঅবস্থার ইতিহাস মসৃণ মখমল না, তা অর্জন। অর্জন অবহেলা ও অবজ্ঞায় হেলা করে অযত্নে লালন করলে তা ক্ষয়ের দিকেই যাবে বর্ধিত হবে না। নারীর ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীকেই সচেতনার ভিত্তি মজবুত করে দৃঢ় চিত্ত শিরে আঁকতে হবে আগামীর স্বপ্নিল ছবি। আজকের ছবি স্মৃতি হয়ে নিশ্চিত প্রেরণা জোগাবে পরের প্রজন্মের নারী প্রজন্মকে। …নারী, তুমি সবল হও, সরব হও, দৃঢ় হও আরো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)