চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নারীর আঁচল আসল আশ্রয়

প্রতিনিয়ত ঘরে বাইরে পুরুষের হাতে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারী। তাতে কেউ প্রতিবাদ করে আঙ্গুল তুলছেন, আবার কেউ বা মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছেন সবকিছু। তবে ইদানিং নারীদের ওপর নৃশংসতা মহামারি আকারে ধারণ করেছে।

সাংস্কৃতিক সংগঠন বাতিঘরের পরিচালক ও সৃজনশীল প্রকাশনী পাললিক সৌরভ-এর প্রধান নির্বাহী তামান্না সেতু তার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করে লিখেছেন:

‘আমার বক্ষে ঠিক কতজন পুরুষ স্পর্শ করেছে তা গুনে বলা দুষ্কর। তবে আমার সন্তান সম্ভবত তার মায়ের চোখের প্রতিটি জলের হিসেব রেখেছে। বাসে উঠতে-নামতে, মার্কেটে, ওভার ব্রিজে, ফুটপাতে এমনকি বোনের বিয়ের বড়যাত্রী বরণেও কিছু নাম না জানা হাত ছুয়ে গেছে আমায়।

তারপরও ঠিক ঐ বাড়ির বউ হয়েই গিয়েছে আমার বোন। কি করার আছে? প্রথমে নিজের ভেতর নিজে গুটিয়ে গিয়েছি। দু’দিন হয়তো স্কুলে যাইনি, এক বেলা ভাত খাইনি, কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছি কিন্তু তারপর? বাস্তবতা আর বয়ে চলা সময় আমাকে আবার নিয়ে ফেলেছে রাশি রাশি হাতের ভিড়ে।

দিনের পর দিন হরতাল দিলে যেমন একটা সময় যে দলের হরতাল সে দলের মানুষকেও জীবিকার টানে পেট্রোল বোমার ভয় নিয়েই বাসে উঠে বসতে হয়। ঠিক তেমন আমাকেও বের হতে হয়েছে। বাসে উঠতে হয়েছে, মার্কেটে যেতে হয়েছে। আর হাতগুলো একটাবারও ক্ষমা না করে আমায় ছুঁয়ে গেছে। আমি আবার কিছুদিন কেঁদেছি, মগের পর মগ পানি দিয়ে গোসল করেছি!! হায়রে সব ধুয়ে যায় কেবল আমার বিবেক ধুয়ে যায় না।

নিজের এমন ভয়াবহ স্মৃতির কথা শেয়ার করে তামান্না সেতু লিখেন:  খুব পরিষ্কার একটা স্মৃতি একদিন নিউ মার্কেট গিয়েছি বার হাত লম্বা শাড়ি পড়ে, ঘার তোলা ব্লাউজ। পাশ দিয়ে দু’জন ছেলে চলে গেলো, বয়সে আমার ছেলের থেকে ৪/৫ বছরের বেশী হবে বড় জোর। বললো -“এই যে, এতো ঢেকে রাখলে আমরা কি দেখব”?

কথাটা কানে আসার সাথে সাথে আমার পা টা কেমন দুলে উঠলো! খপ করে পাশের দোকানের দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। আমার বড় ছেলেটা তখনও কিছু না বুঝে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে বলছিলো- “মা, শরীর খারাপ করলো?”

তারপরও ভীষণ রকম সম্মান ঠিক রাখার দায় নিয়ে আমাকে বলে বেড়াতে হয় -“কই আমায় তো কেউ কোনোদিন বাজে কথা বললো না। ছোঁয়া তো দূরের কথা!”

শুনুন, এই মিথ্যেটা আপনাদের সকলের স্ত্রী, বোন, মা মেয়ে বলে বেড়াচ্ছে আপনাদের কাছে। আজ ভাবি ঠিক কার সম্মান ঠিক রাখলাম? নিজের নাকি ওই হাতগুলোর?

ছোটবেলায় সাঁতার শেখবার সময় একবার পানিতে ডুবতে বসেছিলাম। পাশের বাড়ির এক ছেলে ঠিক সময় খপ করে আমার হাতটা ধরে টেনে তুলল। সেই ছেলেটির মুখ আমি চিরকাল বাসে, মার্কেটে, ওভারব্রিজে খুঁজে বেড়াই। কখনও যে পাইনি তাও তো না। কিন্তু লাখো হাতের ভিড়ে সে মুখ প্রায়ই হাড়িয়ে যায়।

ঠিক কি প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই পথ বেছে নিয়েছে সেই হাতগুলো আমি জানি না। কি চায় তারা? নারী মুক্ত পথ? হাট-বাজার? অফিস আদালত? কার লেখায় যেন পড়েছিলাম একদিন (শুভজিৎ হয়ত) – কোনো এক রমণীর গায়ে হাত দেবার চেষ্টায় যখন এক যুবক অন্যদের মার খেয়ে অচেতন তখন সেই মহিলাকেই দেখা গেলো পরম স্নেহে সেই যুবককে পানি খাওয়াতে।

আমি এখনো জানি না ঠিক কি চায় তারা। শুধু জানি এ পাপের ভার যেদিন সইতে না পারবেন সেদিন মাথা গোঁজার জন্য একজন নারীর আঁচল ভীষণ জরুরী হয়ে পরবে।

পোস্টে সেতু আরো লেখেন, গত বর্ষায় আরাফকে (আমার ছেলে) নিয়ে গিয়েছিলাম ক্রিসেন্ট লেকে। কদম ফুলটা ওখানে খুব পাওয়া যায়। আমি লেকের জলে পা ধুচ্ছি নিচু হয়ে হঠাৎ টের পেলাম আমার কাঁধে কারো হাত। ভাবছি ঘুরেই একটা চড় কশাবো সজোরে, সাহস পাচ্ছি না। না ভয়ে নয়, আশায়। আশা- নিশ্চয়ই ঘুরে দেখবো আরাফ ঠিক খুঁজে খুঁজে এক গোছা কদমফুল এনে দাঁড়িয়েছে আমার পিছে- “মা, এই যে তোমার বর্ষার প্রথম কদম ফুল”। আমি ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছি। আমার কাঁধের কাছে হাতটা আরও একান্ত হচ্ছে। নিশ্চয়ই আরাফ। আর কেউ অযথা কেন হতে যাবে?

আমি ভীষণ আশা নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছি। আমরা ভীষণ আশা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছি। নিশ্চয়ই পিছনে এক জোরা পবিত্র হাত আমাদের অপেক্ষায়। নিশ্চয়ই।