২২ আগস্ট, ২০১৯। স্থান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন। সময়: সন্ধ্যা ৭টা। সাংবাদিক সায়মন ঘুরতে ঘুরতে ঢুকলেন সেখানে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন বিএনপি-জামাত জোট সদ্য ক্ষমতায়। বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল হলগুলোর দখল নিয়েছে। ছাত্রলীগ কদাচ হলগুলোতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিরোধীদল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ তেমন কোন কার্যক্রম চালাতে পারেনি। তবে হলগুলোতে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী থাকতো। যখন তিনি হল ছাড়েন, তখন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। সাংবাদিকতায় যোগ দেয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক পড়াশুনা ভিত্তিক সংগঠন চালানোর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এখনো যাওয়া-আসা রয়েছে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয় লাভ করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। যথারীতি হলগুলো বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদল শূন্য। ছাত্রলীগ ছাত্রদলের সময়ের চেয়ে কিছুটা আগ্রাসী। তাই পরবর্তী ৫ বছরই ক্যাম্পাসে কোনো কর্মকাণ্ড চালাতে পারেনি ছাত্রদল। ২০১৪ সালে আবারো ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সরকারের আগের মেয়াদের মতো এই পাঁচ বছরও ছাত্রদল শূন্য ক্যাম্পাস। এখন তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার।
এই ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ এই দীর্ঘ দেড় যুগে সায়মন দেখেছেন বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে, দাবি উঠেছে। কিন্তু ‘যেই লাউ, সেই কদুতে’ই আটকে ছিলো সব কিছু।
১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ বডি সিনেট। সিনেটে ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকে। ১৯৯১ সালের পর থেকে কিছুদিন আগ পর্যন্তও দীর্ঘদিন ডাকসুর নির্বাচন নেই। স্বভাবতই নেই নির্বাচিত প্রতিনিধি। এই সময়ে এসে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অসম্পূর্ণ সিনেটের দাবি তুলে হাইকোর্টে রিট করে। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ও বহুল আলোচিত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হয় গত ১১ মার্চ।
নতুন ডাকসুর আগে ও পরে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে ডাকসু ভবনটি তিন তলা বিশিষ্ট। এর দ্বিতীয় তলায় ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি, জিএসসহ অন্যান্যদের জন্য বসার ব্যবস্থা রয়েছে। আছে গেমস রুম, কনফারেন্স হল। দীর্ঘদিন ডাকসু না থাকায় দ্বিতীয় তলাটি ছিল ভুতুড়ে। ডাকসু বলতে সবাই বুঝতো নিচ তলার সংগ্রহশালাকে। নির্বাচনের পর থেকে এখন আর সেই দৃশ্য নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধি, শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় সন্ধ্যায় আলো ঝলমলে থাকে ডাকসুর দ্বিতীয় তলা। যেনো এক প্রাণের স্ফুরণ।
‘আপু এখন ডাকসুর যুগ, বাক-স্বাধীনতার যুগ, ছাত্রলীগের ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করা যাবে না যাবে না’
কাকন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। কেন্দ্রিয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। একটি ছেলে তার সামনেই ছাত্রলীগের সমালোচনা করছে।
কাকন বললেন, ‘কিরে তোমার দেখি বোল ফুটেছে। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো, আপু এখন ডাকসুর যুগ। আপনি চাইলেও আমাদের বাক-স্বাধীনতা হরণ করতে পারবেন না।’নতুন ডাকসুর অর্জন
শুরুতেই যে দৃশ্যকল্প বলেছিলাম, তা শেষ করা প্রয়োজন। সায়মন মধুর কেন্টিনে ঢুকেই দেখে ছাত্রদলের পরিচিত এক নেতাকে। মিনহাজ ভাই জহুরুল হক হলের নেতা ছিলেন; সায়মস যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন।
সায়মন সেখানে গিয়ে বসলেন। দূরে দেখলেন আরেকটি টেবিলেও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা কয়েকজন। পুরো ক্যান্টিনে ক্ষমতাসীন দলের তেমন কেউ নেই। এটি ডাকসু নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত ছিলো কল্পনাতীত। সেটি স্বীকারও করেছে ছাত্রদলের উপস্থিত নেতাকর্মীরা। ক্ষমতাসীন দল কোনভাবেই বিরোধীদলের ছাত্র সংগঠনকে স্থান দিতো না ডাকসু পূর্বে। অথচ কি আশ্চর্য নতুন ডাকসু হওয়ার মাত্র ৫ মাসের মাথায় সহ-অবস্থানের কি দারুণ দৃশ্য।
ডাকসু দ্বিতীয় তলায় ভিপির রুমে বসে আছেন তারই প্যানেল কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ভোটে জেতা সমাজসেবা সম্পাদক। সায়মন পুরো ডাকসু নির্বাচন আগাগোড়া কাভার করলেও আখতার ভুলে গেছে। যাই হোক সায়মনকে চেনেন এমন একজন পরিচয় করিয়ে দিলো। ডাকসুর এই রুমে দারুণ সুন্দর চেয়ার টেবিল আছে; আছে ছোট একটি সোফাও। একটি টেলিফোন সেটও আছে। অন্যান্য সরঞ্জাম তো আছেই।
কথা বলতে বলতে আখতারের কণ্ঠে অনুযোগ, ‘ভাই মেয়েদের হলগুলোতে অনলাইন সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বন্ধে তারা পুলিশের ৯৯৯ সেবার সাথে যৌথভাবে একটি উদ্যোগ নিতে চায়। ছাত্রলীগের জিএসসহ অন্যরা সে উদ্যোগ নিতে দিচ্ছে না।’
সায়মনের কাছে পরামর্শ চান; এখন কি করবে তারা। সাংবাদিক সায়মন পরামর্শ দেয়াও পছন্দ করে না, নেওয়া তো নয়-ই। আখতারকে তাই তার পাল্টা জিজ্ঞাসা, ‘এই যে এখানে বসে ছাত্রলীগের বিরোধীতা করে কাজ করার চেষ্টা করছো। এত চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করছে, এটি কি কম অর্জন বলে মনে হয়? কেউ কি কখনো ভেবেছিলো ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নাকের ডগায় অন্যরা ডাকসু চালানোর ভাগিদার হবে। এবার এতটুকু হচ্ছে। পরের বার আরেকটু এগুবে। চেষ্টা করে যাওয়ায় তো জীবন। হতাশ হওয়া স্থবিরতা।’
আখতার কনভিন্সড হলো কিনা বুঝা গেলো না।
ডাকসুর গর্জন
২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছিলো। পরে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেয় আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে কালো দিবস পালন করা হবে। ২০১৯ সালে দিবসটি পালিত হয় গত ২৩ আগষ্ট ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের অডিটোরিয়ামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক সমিতির সভাপতিসহ ডাকসুর ভিপি উপস্থিত।
সেদিনের ঘটনার কুশীলবদের বিচার নিয়ে কারো কোনো শক্তিশালী বক্তব্য না থাকলেও ডাকসু ভিপি ঠিকই দাবি করলেন, কুশীলবদের বিচার। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র ও বিরিয়ানি আন্দোলন নাম না দিয়ে দাবির যৌক্তিকতা বিচার করে সমাধান করার আহ্বান তার।
এই নুরুল হক নুরু বলতে গেলে নিয়মিত বিরতিতে মার খাচ্ছেন। তারপরও থামছেন না। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এত মার খাচ্ছেন তবু পদ ছেড়ে দিচ্ছেন না কেনো?
তার উত্তর, ‘ভাই আমি তো জীবন উৎসর্গ করেছি। যে জীবন উৎসর্গকৃত সে জীবনে মরণের ভয় দেখানো বৃথা।’
এটাই তো ডাকসুর সবচেয়ে বড় অর্জন ও গর্জন। ডাকসুর ২৫টি পদের মধ্যে ২৩টি আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের। অন্য দুটি কোটা বিরোধী আন্দোলন করে জনপ্রিয়তা পাওয়া সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের। স্বাভাবিকভাবে এমন অসামঞ্জস্য কমিটিতে খুব বেশি ভারসাম্যপূর্ণ কাজ হবে- এমন আশাও করা যায় না। তারপরও অন্তত ২৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি আগামীদিনের বাংলাদেশের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন। কিভাবে বৈপরীত্যের মধ্যে কাজ করতে হয়, তার দীক্ষা নিচ্ছেন। কিভাবে বিরুদ্ধ মতকে নিজ স্বার্থে স্থান করে দিতে হয়, তার শিক্ষা ছাড়াচ্ছেন ঐতিহ্য দিয়ে। এটাই বা কম কিসের!
পাদটীকা
২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলো বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। দুই কমিটি আগে যিনি সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, তার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা ছিলো ওই সময়ের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া ও নির্যাতিত হওয়া। কিন্তু কী অদ্ভূত বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আয়োজিত কালো দিবসের আলোচনায় ছাত্রলীগের উপস্থিতি দেখা যায়নি।
তাহলে কি আমরা ব্যক্তি ছাড়িয়ে দল, দল ছাড়িয়ে দেশের হতে পারবো না? আমরা বলবো না তাদের অধিকারের কথা? যারা আমার অধিকারকে মূর্খের মতো কেড়ে নিয়েছিলো। কবি জসীম উদ্দিনের এই কবিতা কখনো কি ধরা দেবে না বাঙালির রাজনৈতিক জীবনাচরণে?
‘‘আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী;
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হয়েছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাধি তার ঘর ।
আমার একুল ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষ ভরা বান,
আমি দেই তারে বুক ভরা গান;
কাটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,
আপন করিতে কাদিঁয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর ।
মোর বুকে যেবা কবর বেধেছে আমি তার বুক ভরি,
রঙ্গীন ফুলের সোহাগ জড়ান ফুল মালঞ্চ ধরি।
যে মুখে সে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে সখী, তারি মুখ খানি,
কত ঠাই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর,
আপন করিতে কাদিয়া বেড়াই যে মোরে করিয়াছে পর।’’
দেশের রাজনীতি যাইহোক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হোক কবি জসীম উদ্দিনের ‘প্রতিদান’ কবিতার মতোই। ছাত্রজীবনের প্রতিদানের চর্চার প্রভাব পড়ুক বৃহত্তর জীবনে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)