আমিনা নামের একজন সিরিয়ান আশ্রয়প্রার্থী দিন দুয়েক আগে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “আমার ভয় হচ্ছে কোনো একদিন আমি হয়তো ইন্টারনেটে আমার মেয়ের ছবি দেখবো সে না খেয়ে মরে যাচ্ছে!” স্বামী এবং মেয়েকে সিরিয়ায় ফেলে নিজের জীবন হাতে নিয়ে ডেনমার্কে পাড়ি জমালেও, এখন তার মনে শুধু ভয় আর শঙ্কা।
এই ভয় ও শঙ্কার মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে যখন আমিনা জানতে পেরেছেন তার স্বামী-সন্তানকে আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মাঝেও তিনি দেখতে পাবেন না। ডেনমার্কের সরকার তাদের শরণার্থী আইনগুলো কড়াকড়ি করার প্রচেষ্টার সর্বশেষ ধাপে ঘোষণা করেছে: তারা এখন থেকে শরণার্থীদের কাছে মূল্যবান সম্পদের পরিমাণ যদি এক হাজার ডলারের উপর হয়, সেটি তারা জব্দ করবে। সেই সম্পদ বিক্রি করে পাওয়া অর্থ অবশ্য ডেনমার্ক সরকারের কথা অনুযায়ী জনকল্যাণেই আবার ব্যয় করা হবে।
তবে সবচাইতে বড় পরিবর্তনটি আনা হয়েছে “ফ্যামিলি রিইউনিয়ন” আইনে। বলা হচ্ছে যারা শেষ পর্যন্ত ডেনমার্কে থাকার অনুমতি পেয়ে যাবে; তারা তাদের পরিবারের বাকী সদস্যদের ডেনমার্কে নিয়ে আসার জন্য আবেদন করতে পারবে কমপক্ষে তিন বছর পর কিংবা এরও পরে। আগে যেখানে অনুমতি পাওয়ার পরই আবেদন করা যেতো, সেখানে এখন অপেক্ষা করতে হবে কম পক্ষে তিন বছর।
এখানে বলে রাখা ভালো, অনুমতি পেতেই ক্ষেত্রে বিশেষে এক থেকে দুই বছর লেগে যায়। আর অনুমতি পাওয়ার পর পরিবারের অন্য সদস্য যারা হয়তো নিজ দেশে আছে, তাদের জন্য আবেদন করলে, অনুমতি পেতেও ছয় মাস থেকে এক বছর লেগে যায়। অর্থাৎ আগে যদি পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে তিন বছর লাগতো; এখন লাগবে ছয় থেকে সাত বছর।
দুই বছর বয়েসি মেয়েকে দেশে রেখে এসে সিরিয়ান নারী আমিনার সঙ্গী তাই এখন কেবল’ই চোখের পানি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমুদ্রে ভেসে যাওয়া সেই সিরিয়ান বালকের ছবি। আমিনা কেবলই সেখনে নিজের মেয়ের ছবি দেখতে পান আজকাল!
ডেনমার্কের ঘোষণার একদিন পরেই পাশের দেশ সুইডেন ঘোষণা করেছে তারা ৮০ হাজার শরণার্থীকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাবে। তাদের পক্ষে এতো শরণার্থী গ্রহণ করা সম্ভব না। সুইডেন সরকারের এই ঘোষণার দুই দিন আগেই এক শরণার্থী ক্যাম্পে ১৬ বছরের এক শরণার্থী ছেলে এক সুইডিশকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। কোন কারণে, কোন পরিস্থিতে ওই ঘটনা ঘটেছে সেটি এখনো পরিষ্কার না হলেও ঘটনাটি যে একজন শরণার্থী ঘটিয়েছে এটি সুইডেনসহ পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমে এসেছে।
সুইডেন ও ডেনমার্ক হচ্ছে এমন দুটি দেশ, যে দেশ দুটি পৃথিবীর সকল রকম মানবতা সূচকে সব চাইতে উপরের সারির। মানব উন্নয়ন সূচকে তারা সব সময়ই প্রথম দিকে থাকে। দেশ দুটির সাধারণ মানুজন এই নিয়ে গর্বও করে। তাহলে হঠাৎ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে পালিয়ে আশা মানুষগুলো, যারা নিজেদের জীবন হাতে নিয়ে সমুদ্রপাড়ি দিয়ে, হাজার হাজার মাইল হেঁটে এই সব দেশে পৌঁছেছে, তাদের কেনো এই মানবিক দেশগুলো আশ্রয় দিতে চাইছে না? কিংবা সরকার গুলো হঠাৎই কেনো এইভাবে নিজেদের আইন পরিবর্তন করে অমানবিক হয়ে যাচ্ছে?
এর আসলে কয়েকটি দিক রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে যেই দেশগুলো প্রচুর পরিমাণে শরণার্থী আশ্রয় দিয়েছে তারা এখন একটা বার্তা দিতে চাইছে সেই সব শরণার্থীদের যারা এখনো তুরস্ক কিংবা অন্যান্য দেশে শরণার্থী হিসেবে আছে, কিন্তু পরিকল্পনা করছে ইউরোপে পাড়ি জমাতে। তাই ইউরোপের সরকারগুলো এমন একটা বার্তা দিতে চাইছে যে, শরণার্থীদের জন্য তারা আইন কঠিন করছে। ইউরোপে থাকা তাদের জন্য সহজ হবে না, পরিবারের অন্য সদস্যদের সহজে আনা যাবে না। তাহলে হয়তো শরণার্থী আসার চাপ কিছুটা কমবে।
এছাড়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই বিষয়ে তুরস্কের সাথে একটা চুক্তিও করেছে যাতে করে তুরস্ক সরকার তাদের দেশে সিরিয়া থেকে আশা শরণার্থীদের সমুদ্র কিংবা অন্য পথে ইউরোপে যাওয়া বন্ধ করতে পারে।
তবে এইসব কিছু ছাড়িয়ে যে বিষয়টি নিয়ে সবচাইতে বেশি আলোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে যারা শরণার্থী বিষয়ে কাজ করছে, সেটি হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো আসলে শরণার্থী বিষয়ে এক হয়ে একযোগে কাজ করতে সক্ষম হয়নি। দেশগুলোর মাঝে কোনো রকম সমঝোতাও হয়নি এ নিয়ে। এজন্য জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্কসহ কয়েকটি দেশেই দেখা যাচ্ছে শরণার্থীদের চাপ বেশি; অন্য দেশগুলো সেই অর্থে শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে এক প্রকার অস্বীকার করেছে। এমনকি শরণার্থীরা যাতে ঢুকতে না পারে সেই জন্য ডেনমার্ক ও সুইডেন বর্ডারে এখন নিয়মিত আইডি চেক করা হচ্ছে। যাদের আইডি কার্ড নেই তাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
অথচ, সেনজেন চুক্তির পর ইউরোপের ২৬ টি দেশে আসলে কোনো রকম বর্ডার চেক হয় না। মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে এই ২৬টি দেশে নাগরিকদের মাঝে বেশ একটা গর্ব ছিল এই বলে যে, তাদের মাঝে ঐক্য আছে; যার কারণে কোনো রকম বর্ডার চেক আপ পর্যন্ত করতে হয় না। কিন্তু ২০১৫ সালে শরণার্থী সমস্যার পর এ নিয়ে নানান জটিলতা শুরু হয়েছে।
এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়, এই জটিলতা কি কেবলই শরণার্থীদের জন্য, নাকি মানবতার আদর্শ হিসেবে পরিচিত ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলো নিজেরা কোনো সমঝোতায় না আসার কারণ এটি! এক ইউরোপ কিংবা ইউরোপের ইউনিটি যে কিছুটা হলেও এখন হুমকির সম্মুখীন সেটা কিন্তু ঠিকই বোঝা যাচ্ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)