যে কোনো সময় বড় একটি সাইবার যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে রাশিয়াকে বৈশ্বিক ইন্টারনেট থেকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনার কথা বলেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাশিয়া ইন্টারনেট থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকতে পারে কি না, তা পরখ করতেই এই পরিকল্পনা।
কিন্তু দায়িত্বহীন বিশ্বনেতৃত্বের কারণে আশঙ্কায় থাকা পুতিন নিজেই সাইবার যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বনেতৃত্ব যাদের হাতে পড়েছে তাদের ওপর আমরা আস্থা পাচ্ছি না। আমাদের বিশ্বনেতা হচ্ছেন ট্রাম্প, পুতিনের মতো রাষ্ট্রনায়কেরা, যারা গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরশাসন করছেন। অন্যদিকে নর্থ কোরিয়ায় আছেন কিম আর ফিলিপিন্সে দুতার্তে। এর মাঝে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থা, ইতোমধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধও চলছে। কাজেই সাইবার যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির প্রসঙ্গ টেনে এই শিক্ষক বলেন, সাইবার জগত নিয়ে বিশ্বনেতাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশের ও এক্ষেত্রে সতর্ক থাকাটা খুব জরুরি।
কিন্তু সাইবার জগতে সতর্কতার জন্য যথেষ্ট কাজ আমরা করছি না বলে মন্তব্য করেছেন রোবায়েত ফেরদৌস। ‘উদাহরণ হিসেবে বলি আমরা অনেকগুলো দূর্গ বানিয়েছি, কিন্তু কোনো পাহারাদার রাখিনি। ফলে যে কেউ সেখানে ঢুকে আমাদের সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে। ফলে পুতিন যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেটি শুধু রাশিয়ার জন্য না, কোনো ক্ষেত্রেই উড়িয়ে দেয়া যায় না।’
আসলেই কি সাইবার যুদ্ধ আসন্ন?
এ ব্যাপারে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার অনেকটা জোর দিয়ে বলেছেন, ভবিষ্যতের যুদ্ধের নামই হচ্ছে ‘ডিজিটাল যুদ্ধ’। বর্তমান প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের যুগে শুধু অনলাইনভিত্তিক ‘সাইবার’ শব্দটি ব্যবহার করতে চান না তিনি।
চ্যানেল আই অনলাইনকে মন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর সামনের যুদ্ধগুলো পেছনের চেয়ে অনেক বেশি ডিজিটাল হবে এবং যে কোনো পর্যায়েই এটি হতে পারে। কেননা বর্তমানে পৃথিবীতে অপরাধ, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগসহ অন্যান্য বিষয়গুলোরও প্রকৃতি আগের চেয়ে বদলে গেছে।
তবে চাইলেই রাশিয়ার পক্ষে বৈশ্বিক ইন্টারনেট থেকে পুরোপুরি সরে থাকাটা সম্ভব নয় বলে মনে করেন মোস্তফা জব্বার। বলেন, ‘ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন বোধহয় একটা দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হবে। আমি হয়তো কোন একটা কাজ ইন্টারনেটে না করতে পারি। কিন্তু পুরো দেশ নিয়ে একেবারে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের ইন্টারনেট পরিসরে অবরোধ আরোপের হুমকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চীন রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও বাকি পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যকার বিরোধ নতুন নয়। এটি ইন্টারনেটের যুগে শুরু হয়নি। সেই স্নায়ুযুদ্ধ থেকে এর ধারা অব্যাহত আছে। হয়তো এর পরিসর বিস্তৃত হতে পারে।
তবে যেহেতু এটি পক্ষভিত্তিক বিরোধ, সেহেতু রাশিয়াকে এভাবে অনলাইন পরিসরে একঘরে করে ফেলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন এই প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। ‘অন্য দেশগুলো নিশ্চয়ই চাইবে না কেউ কারো কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হোক,’ বলেন তিনি।
সাইবার যুদ্ধকে একটি ‘চলমান প্রক্রিয়া’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক। তিনি বলেন, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এবং হ্যাকারদের মধ্যে টানা এই যুদ্ধ লেগে আছে। ডিজিটাল জগতে এমন টানাপোড়েন সবসময়ই থাকবে। সুতরাং সাইবার যুদ্ধ আসন্ন এমন কোন কথা নেই। এটি ইতোমধ্যে চলছে। হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে এর মাত্রা বাড়ে-কমে।
বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটে যত অপরাধ ঘটছে এর সবচেয়ে বড় অংশ রুশ হ্যাকাররাই করছে বলে মন্তব্য করে আরিফ জেবতিক বলেন, ব্ল্যাক সফটওয়্যার অর্থাৎ ক্ষতিকর যেসব সফটওয়্যার ব্যবহার করে অপরাধমূলক কাজ করা হয় এগুলোর একটা বড় অংশ তারা তৈরি ও ব্যবহার করে। উদাহরণ হিসেবে জানান, ফেসবুক ও টুইটারে লাইক-কমেন্টকে ব্যবহার করে যে মার্কেটিং, তা একচ্ছত্রভাবে এই রুশ হ্যাকাররেই নিয়ন্ত্রণ করছে।
বিশ্ব ইন্টারনেটের এই যুগে কেউ চাইলেই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে পারে না বলে উল্লেখ করেন এই অ্যাক্টিভিস্টও। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া নিজে বা অন্যরা এ বিষয়টাকে কীভাবে দেখবে তা হয়তো সময় বলে দেবে। কিন্তু এখন যে ইন্টারনেটের বাইরে থাকবে সে আসলে পৃথিবীর বাইরে থাকবে।’
আরিফ বলেন, প্রতিদিন নিত্যনতুন ধরনের সফটওয়্যার, প্রোগ্রাম আবিষ্কারের ফলে অন্যের ওপর ইন্টারনেটে আক্রমণ করার আরও নতুন নতুন পদ্ধতি বের হচ্ছে। এ কারণে সবাইকেই তাদের ডিফেন্স মেকানিজম বা প্রতিরক্ষা কৌশল নিয়মিত বাড়াতে হয়। যেমন, প্রতিদিনই নতুন নতুন ধরনের ভাইরাস তৈরি হচ্ছে বলে কম্পিউটারের এন্টিভাইরাস ক’দিন পরপরই আপডেট করতে হয়। রাশিয়ার বিষয়টাও তেমনই। ‘বিশেষ করে এই সম্পর্কে যেহেতু বসে ইন্টারনেটে রাশিয়ার খারাপ নজরদারির বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে, সুতরাং তারা হয়তো ভাবছে তাদের উপরে পাল্টা একই ধরনের আক্রমণ হতে পারে।’
ইন্টারনেট থেকে পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্ভব না বলে জানান রোবায়েত ফেরদৌসও। বলেন, এক্ষেত্রে নিজেদের মতো করে বিকল্প কোনো উপায় ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘তবে বিশ্বায়নের যুগে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা মানেই হচ্ছে পিছিয়ে পড়া। কেননা একটি দেশকে অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতেই হবে। ইন্টারনেট না থাকলে এখনকার সময়ে সে কীভাবে বাণিজ্য করবে?’
কোনো এক দেশ নয়, অনেকগুলো পক্ষ একসঙ্গে চাইলে হয়তো রাশিয়ার মতো একটি দেশকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া সম্ভব হতেও পারে বলে মন্তব্য করেছেন রোবায়েত ফেরদৌস। তবে তিনি বলেন, অন্যান্য রাষ্ট্রনেতাদের হুমকির জবাবে পুতিনের কথাগুলো এক ধরনের হুমকি। এই পারস্পরিক হুমকি বিশ্বনেতাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে দায়িত্বশীল ভূমিকায় ঘাটতির ফল।