জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) তুরস্কে অফিসিয়ালি সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত এবং তুর্কি ভূখণ্ডের জন্য সরাসরি হুমকিও। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, আইএসকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে আঙ্কারা এবং জঙ্গিদের সফলতা থেকে ফায়দা নিচ্ছে দেশটি।
তুরস্কের বড় সমালোচক এখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তিনি। তুরস্কের সঙ্গে প্রায় সবধরনের সম্পর্ক স্থগিত করার পর পুতিন অভিযোগ করেছেন, জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে তেল ব্যবসা নিরাপদ করতেই যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে তুরস্ক।
আর পুতিনের অভিযোগের জবাবে তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তিনি বলেছেন, আইএসের সঙ্গে তেল ব্যবসার উদ্দেশে আঙ্কারা রুশ বিমান ভূপাতিত করেছে বলে মস্কো যে অভিযোগ করেছে তা প্রমাণ করতে পারলে পতদ্যাগ করবেন।
আসলে কে সত্য বলছে? তুরস্ক কি আসলেই আইএসকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে?
সমালোচকরা বলছেন, কোনো রকম আপত্তি না করে আইএসের সঙ্গে মিত্রতা গড়েছে তুরস্ক। কারণ আইএস ও আঙ্কারা উভয়ই সিরিয়া প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের বিরুদ্ধে এবং দুপক্ষই চায় আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চায়।
তবে জঙ্গি গোষ্ঠীকে সাহায্য করার অভিযোগকে জঘন্য মিথ্যা বলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এরদোগান। তিনি বলেছেন, ‘আইএসের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই, তাদের সঙ্গে তুরস্কও কোনো কাজ করছে না। বরং আইএসের উত্থানের শুরুতে আমরা তাদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছি এবং তালিকাভুক্ত করেছি।’
এ বছর তিনটি বড় ধরনের হামলায় কেঁপেছে তুরস্ক। একটি হামলা হয় প্রো-কুর্দিশ পিপলস ডেমোক্রেটিকস পার্টির (এইচডিপি) সমাবেশে। পরের হামলা হয় সিরিয়া সীমান্তবর্তী কুর্দি অধ্যুষিত শুরুক শহরে। আর সর্বশেষ ১০ অক্টোবর রাজধানী আঙ্কারায় এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১০৩ জন নিহত হয়। এই তিনটি হামলারই দায় স্বীকার করেছে আইএস।
কিন্তু গোপন কিছু সূত্র বলছে, আঙ্কারা ও আইএসের মধ্যে ভালো রকমের সম্পর্ক আছে। যে সম্পর্কের সূত্র ধরেই আইএসের কাছ থেকে অপহৃত ৪৯ জন নাগরিককে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় তুর্কি। আর এই বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছিলো ২০১৪ সালের জুনে।
বিনিময়ের ঘটনার পর ওই বছরের অক্টোবরে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তুরস্ক এতোই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত যে কাউকে অর্থ এবং অস্ত্রসহ সবকিছু দিতে প্রস্তুত। এমনকি জিহাদিদেরও।
তুর্কি কি সত্যিই আইএসের সঙ্গে তেল বাণিজ্য করছে?
বিমান ভূপাতিতের পর গত সোমবার পুতিন বলেন, আইএসের সঙ্গে তেল ব্যবসা নিরাপদ করতেই যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে তুরস্ক।
পুতিন বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা বাড়তি এবং নিশ্চিত তথ্য পেয়েছি যে, আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে তুরস্কে শিল্প পর্যায়ের তেল ঢুকছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস করার সব রকমের কারণ রয়েছে যে, তেলের চালান নিশ্চিত রাখার জন্যই তুরস্ক আমাদের যুদ্ধবিমান বিমান ভূপাতিত করেছে।’
আইএস সিরিয়ার যে অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা তুরস্কের জন্যেই করছে বলে অভিযোগ রুশ প্রেসিডেন্টের। কিন্তু পুতিনের অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতগলু।
আর তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে তেল ব্যবসার উদ্দেশে আঙ্কারা রুশ বিমান ভূপাতিত করেছে বলে মস্কো যে অভিযোগ করেছে তা প্রমাণ করতে পারলে পতদ্যাগ করবেন।
এরদোগান বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনাদের অভিযোগ প্রমাণ করুন। কারণ এর সঙ্গে আমার জাতির মর্যাদা জড়িত।’ তিনি আরও বলেন, অভিযোগ যদি অসত্য হয় তাহলে রুশ প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ করা উচিত।
তিনি পুতিনকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি তা করবেন কি?
উত্তরাঞ্চলীয় সব তেলক্ষেত্রসহ সিরিয়ার প্রায় অধিকাংশ বড় তেলক্ষেত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে আইএস। যা মধ্যে রয়েছে আল-ওমর এবং তানাক তেলক্ষেত্র। যুদ্ধ শুরু আগে আল-ওমর থেকে প্রতিদিন ৩০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলিত হতো।
নাম না প্রকাশ করে পশ্চিমা কূটনীতিকদের একটি সূত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছে, ‘কোম্পানি এবং পরিমাণ সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। তবে এটা পরিস্কার যে, আএস কিছু তেল তুরস্কের কাছে বিক্রি করছে।’
আঙ্কারা ভিত্তিক টিপা ভি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সংগঠনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক নিহাত আলী ওজকান এএফকিকে বলেন, ‘শরণার্থীদের জন্য এরদোগান সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর সীমান্তে তেল চোরাচালান আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।তবে এটা আইএসের তেলের জন্য জরুরি ছিলো না।’
তিনি বলেন, ‘এই তেল চোরাচালান আইএসের উত্থানের আগেও ছিলো। দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্তে সিরিয়া-তুরস্কের চোরকারবারীরা এটা করে আসছে।’
তুরস্ক কি জিহাদিদের সিরিয়া প্রবেশে সাহায্য করছে?
সিরিয়ার সঙ্গে ৯১১ কিলোমিটারের (৫৬৬ মাইল) সীমান্ত তুরস্কের। এই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সন্ত্রাসীরা কিভাবে সিরিয়ায় প্রবেশ করছে এবং তুর্কি কেন তা বন্ধ করতে পারছে না, সেজন্য তুরস্কের কড়া সমালোচনা করছে পশ্চিমা বিশ্ব।
কিন্তু তুরস্ক বলছে, তারা আইএসের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থাই নিয়েছে। এছাড়া আইএস প্রতিরোধে পশ্চিমাদের আরও গোয়েন্দা তথ্য সহযোগিতার আহবান জানিয়েছে দেশটি।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাজধানী ইস্তাম্বুলসহ সেখানে আইএস বিরোধী অভিযান বেড়েছে এবং সীমান্ত অতিক্রম করার সময় প্রতিদিনই নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে আটকের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
তুর্কি অফিসিয়ালরা জানিয়েছেন, বিশ্বের প্রায় ২৬ হাজার ৬০০ জিহাদির নাম তালিকাভুক্ত করেছে তারা। জঙ্গি প্রতিরোধে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় সিরিয়ার সীমান্তবর্তী হাতায়ে প্রদেশে পাকা দেয়াল তৈরি করছে তুরস্ক।
একজন পশ্চিমা কূটনীতিক এএফপিকে বলেন, প্যারিস হামলার পর আমরা তুরস্ককে কিছু প্রশ্ন করেছি। প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো পাইনি। তবে উন্নতি যে হয়নি তা নয়, এ ব্যাপারে আরো উন্নতি প্রয়োজন।