আইন অঙ্গনের নক্ষত্র খ্যাত ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আজ আমাদের থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক এই অ্যাটর্নি জেনারেলের মৃত্যু শোক ছুঁয়ে গেছে আইন অঙ্গন সংশ্লিষ্ট সবাইকে। তার শূন্যতা অপূরণীয় হলেও তিনি আমাদের মাঝে শ্রদ্ধার বাতিঘর হয়ে থাকবেন।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একজন আইনজীবী হিসেবে যেমন ছিলেন প্রাজ্ঞ ঠিক তেমনই সমাজ সেবক হিসেবে ছিলেন সর্বমহলে নন্দিত। যেমন উপার্জন করেছেন তেমনই হাত খুলে অর্থ বিলিয়েছেন অসহায় মানুষের কল্যাণে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ ও মেডিক্যাল কলেজ।
দেশসেরা এই আইনজীবী মামলা লড়ার ক্ষেত্রে ছিলেন অকুতোভয়। ‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেক আইনজীবীই যখন নিরব তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনি লড়াই করেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। পেশাগত জীবনে সরাসরি দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত না হওয়া এই মানুষটি ছাত্র জীবনে পেয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য। আর একজীবনে অর্জন করেছেন বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও ব্রিটেনের নাগরিক হওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে আজ চূড়ান্ত সত্য হচ্ছে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আর আমাদের মাঝে নেই। এমন শূন্যতায় স্যারের সাথে থাকা কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি মনে পড়ছে। সময়টা ২০১২ সাল। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিতার্কিক। একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে স্যার প্রধান অতিথি আর আমি তরুণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে বক্তা। সঞ্চালকের ডাকে স্যারকে সামনে রেখে ভয়ে ভয়ে মঞ্চে উঠলাম। আইন-আদালতের অপ্রত্যাশিত কিছু বাস্তবতা তুলে ধরে স্যারের কাছে জানতেই চাইলাম এসবের জন্য কে দায়ী? আপনাদের মত জ্যেষ্ঠদের কি কোন দায় নেই? কিংবা আপনারা নিরব কেন? সর্বোপরি এমন বাংলাদেশ কী প্রত্যাশা করেছিলেন? স্যার মঞ্চে বসে মৃদু হাসলেন। এরপর প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে আমার প্রশ্নের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, ‘আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের বয়স কিন্তু তত নয়। তবু আমাদের দেশটি পৃথিবীর অনেক দেশের থেকে এখনও ভালো আছে। রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলে দেশটা আরও এগিয়ে যেত। তবে এটা বিশ্বাস করা উচিত যে, একদিন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আর আমরা যা পারিনি তোমাদের মত তরুণরা তা করে দেখাবে।’
এরপর ওই বছরই স্যারের সাথে আবার দেখা হয় তারা বাসা ‘সুবর্না’য়। রাজধানীর পুরানা পল্টনের ওই বাসায় স্যারের একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। ওই সময় চারদিকে একটা গুঞ্জন ছিল যে, ব্যরিস্টার রফিক-উল হক পরবর্তিতে দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন। এ বিষয়ে জানতেই স্যারের কাছে যাই। তবে স্যারকে এমন প্রশ্ন করার আগে আমার মধ্যে ভীষণ ভয় কাজ করছিল। কারণ, আগে থেকেই জানতাম স্যার মাঝে মাঝে রেগে যান। একপর্যায়ে ভয়ে ভয়ে স্যারের বাসায় গেলাম। স্যার বাসার দোতলা থেকে নিচতলার চেম্বারে এসে বসলেন। আমি পরিচয় দিয়ে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন প্রশ্ন করা শুরু করলাম। তবে মনে-মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, প্রেসিডেন্ট সংক্রান্ত প্রশ্নটা সবার শেষে করব। কারণ, স্যার যদি রেগে যান এবং পরে যদি আর কোন উত্তর না দেন তাহলে কিছু উত্তর নিয়ে তো ফেরা যাবে। এই ভাবনা অনুযায়ীই একে একে স্যারের মানব সেবা ও আইন পেশা সংক্রান্ত বিষয়ে জানলাম। অবশেষে বললাম, স্যার আপনি যদি রাগ না করেন একটা বিষয় জানতে চাই? স্যার বললেন, কী জানতে চাও?। বললাম, স্যার ইদানিং অনেকেই বলছেন আপনি পরবর্তীতে দেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার উত্তর কী? স্যার কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বললেন, ‘যারা ক্ষমতায় আসবে তারাই প্রেসিডেন্ট বানাবে। আর প্রেসিডেন্ট আমাকে করবে, নাকি অন্য কাউকে করবে কী করে বলব?। স্যারের এই উত্তরকেই শিরোনাম করে পরে তার সাক্ষাতকার লিখলাম।’
এরপর সুপ্রিম কোর্ট বিটে সাংবাদিকতার সূত্রে স্যারের সাথে অনেকবার দেখা ও কথা হয়েছে। নিউজের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় ফোনে স্যারের মন্তব্যও নিয়েছি। আর আদালতে কয়েকটি শুনানিতে স্যারের যুক্তিনির্ভর বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হয়েছি। দেশের উচ্চ আদালতও অনেক বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে ব্যরিস্টার রফিক-উল হকের অভিমত নিয়েছেন। তবে অসুস্থতার কারণে টানা কয়েক বছর স্যার আইন আদালত থেকে দূরে ছিলেন। নিজ বাসা সুবর্নায়ই কাটছিল তার একাকী জীবন। অবশেষে দেশের এই প্রবীণ আইনজীবী আজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বনানী কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন তিন। এমন শূন্যতার দিনে তার একমাত্র ছেলে রয়েছেন দেশের বাইরে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)