দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল যে ঘটনা; তাতে থমকে গেছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত। এদেশের তৈরি পোশাক কিনতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছিল ক্রেতারা। আস্থা হারিয়ে তাদের অনেকেই চলে গিয়েছিল অন্য দেশে। তবে এত প্রতিবন্ধকতার পরও থেমে থাকেনি পোশাক শিল্প।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পরও গত ৫ বছরে এ খাতে দেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে।
উদ্যোক্তা ও অর্থনীবিদরা বলছেন, ক্রেতাদের শর্ত মেনে, এ খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার, প্রচুর বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ায় রপ্তানি বেড়েছে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যমতে, রানা প্লাজা ধসের পর ওই অর্থবছরে (২০১৩-১৪) রপ্তানি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ২৪ বিলিয়ন ডলার। আর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এরপর ক্রমান্বয়ে রপ্তানি বেড়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে। যদিও নানা কারণে এই সময় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি উঠানামা করেছে।
আর চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। উদ্যোক্তারা মনে করছেন অর্থবছর শেষে এর পরিমাণ ৩০ থেকে ৩২ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।
তবে একটি জায়গায় বড় পরিবর্তন দেখা গেছে। তা হলো ওই ঘটনার পর দেশে পোশাক কারখানার সংখ্যা বাড়েনি। বরং কমেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে কারখানার সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৮৬৭টি। কিন্তু ১ হাজার ৬শ ২২টি কমে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ২শ ২২টি। এরপর ধীরে ধীরে বেড়ে চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৪ হাজার ৬শ। অবশ্য কারখানা সংখ্যা কমলেও উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে।
আর এই সময়ে শ্রমিকের ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য ঘটেনি। দুর্ঘটনার সময় এ খাতে শ্রমিক ছিল ৪০ লাখ। যা এখনও বিদ্যমান।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন ইএবির সভাপতি সালাম মুর্শেদী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স ও নেশনাল অ্যাকশান প্লান (এনএপি) গঠিত হয়। এসব জোট ও প্লানের শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ অনেক কারখানা ছিল শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে।
‘কিন্তু ক্রেতারা সেসব কারখানাকে উৎপাদন চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়নি। তাদের থেকে পণ্য আমদানির নিশ্চিয়তা দেয়নি। ফলে নিরুৎসাহী হয়ে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। রাজধানীতেই প্রায় ৮০ শতাংশ কারখানা বন্ধ রয়েছে। এরপরও উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ বাড়িয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখছে। রপ্তানি বাড়াতে চেষ্টা করছে। তাই বাধা ডিঙ্গিয়ে রপ্তানি বাড়ছে।’
ইএবির সভাপতি বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। এসব নীতির সাথে প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের নীতি সমন্বয় করেছে। যেমন ডলারের তুলনায় প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রার মান বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে হারে বাড়েনি। এছাড়া ধাপে ধাপে তেলের দাম কমানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এসব বিষয়ে সমন্বয় করতে পারেনি। সমন্বয় করলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আরো বেশি হতো।
কারখানা সংস্কার করায় উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও সে তুলনায় ক্রেতারা উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানি উল্লেখ করে সালাম মুর্শেদী বলেন, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা বার প্রতিশ্রুতি দিলেও পণ্যের দাম বাড়ায়নি। নতুনা রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি হতো।
বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান মনে করেন, প্রবৃদ্ধি কমলেও মোট রপ্তানি বেড়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর ক্রেতাদের আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে। এই আস্থা ফেরাতে উদ্যোক্তারা নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।
তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের ওপর ক্রেতাদের আস্থা কমে গেছিল। ফলে গার্মেন্ট ব্যবসা চলে যায় অন্য দেশে। অর্থাৎ ক্রেতারা আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে এখন ধীরে ধীরে ক্রেতাদের আস্থা ফিরছে। তারা ব্যবসা প্রসার করছে বাংলাদেশে।
এখন রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে উল্লেখ করে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই রপ্তানি হয়েছে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১১ শতাংশ। বাংলাদেশ এখন বিশ্ব মানের কারখানা প্রতিষ্ঠা করছে। উচ্চ মানের পণ্য উৎপাদন করছে। নিজেদের উদ্যোগে বাজারজাত সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এসব কারণেই রপ্তানি বাড়ছে বলে মনে করেন সিদ্দিকুর রহমান।
‘ওই ঘটনার পর কিছু কারখানা কমেছে। কিন্তু এখন আবার নতুন করে অনেকেই উৎপাদনে আসছে। এবং নতুনগুলো সবুজ কারখানা হয়ে আসছে। এসব কারখানায় রপ্তানি বাড়বে উল্লেখযোগ্য হারে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ওই ঘটনার পরও গত ৫ বছরে রপ্তানি বেড়েছে। চলতি অর্থবছর শেষে রপ্তানির পরিমাণ ৩০ থেকে ৩২ বিরিয়ন ডলার হতে পারে। তবে এই সময় হয়তো প্রবৃদ্ধি উঠানামা করেছে। গত দুই তিন বছর ধরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। কিন্তু এটার সাথে রানা প্লাজা ধসের তেমন সম্পর্ক নেই। ডলারের দাম বা অন্যান্য কারণে প্রবৃদ্ধি উঠানামা করে।
তিনি বলেন, এই সময়ে কিছু কারখানা কমে গেলেও নতুন করে মান সম্মত প্রায় ৬শ কারানা স্থাপিত হয়েছে। সেগুলোতে উন্নত পরিবেশে আগের চেয়ে তুলনামূলক উন্নত মানের পণ্য তৈরি হচ্ছে। এখন কম সংখ্যক কারখানা দিয়ে দক্ষতার সাথে অধিক উৎপাদন করতে পারছে বাংলাদেশ। গত ৫ বছরে কারখানার কর্মপরিবেশের মান উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করা হয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে। তাই প্রতিকূল পরিস্থিতি থাকার পরও ক্রেতারা অর্ডার দিয়েছে। এবং রপ্তানিকারকরা তা সফলতার সাথে সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক মারা যান। আহত হন হাজারো শ্রমিক। তাদের মধ্যে অনেকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন।