সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই পেয়েছিলেন বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ। জাতীয় দলে অল্প কিছুদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৭ বিশ্বকাপ খেলতে যান ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ক্যারিবীয় কন্ডিশন সম্পর্কে সেসময় তেমন ধারনাই ছিল না তিন তরুণের। অনভিজ্ঞতা অবশ্য ভীতির সঞ্চার করতে পারেনি। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার কাছে হার মেনেছে প্রতিবন্ধকতা।
ওই সময় পোর্ট অব স্পেনে ভারতের বিপক্ষে শাহরিয়ার নাফীস, মোহাম্মদ আশরাফুল, আফতাব আহমেদ, হাবিবুল বাশারদের ছায়া হয়ে না থাকার মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায় সাকিব-তামিম-মুশফিকের ব্যাটিংয়ে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেই তরুণরাই এখন বাংলাদেশের ভরসার কেন্দ্রস্থল। একযুগ ধরে সবার হৃদয় জয় করে চলেছেন। খারাপ সময় থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালো সময়ে খেলছেন উজাড় করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে সদ্য শেষ হওয়া ওয়ানডে সিরিজেও স্পটলাইটটা তাদের উপরেই।
তরুণ বয়সে সাকিব-তামিম-মুশফিকের দায়িত্বশীল ব্যাটিং বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। বিদেশি ধারাভাষ্যকাররা তাদের নামের পাশে ইনিংসজুড়ে যোগ করে গেছেন নানা বিশেষণ। ত্রয়ীর পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসে ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে ফেরে বাংলাদেশ। ম্যাচসেরা ছিলেন অবশ্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। ৪ উইকেট তুলে নিয়ে লড়াইল এক্সপ্রেস ভারতকে ১৯২ রানে বেধে রাখেন। সেই ম্যাচ জয়ে দারুণ অবদান রাখা চার ক্রিকেটার এখনও বাংলাদেশকে দিয়ে যাচ্ছেন উৎসবের উপলক্ষ। ব্যক্তিগত নানা কীর্তিতে ব্র্যান্ডিং করছেন টাইগার ক্রিকেটকে।
২০০৭ বিশ্বকাপের পরপরই বাংলাদেশ দলে যোগ হন আরেক সারথি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। স্থায়ী আসন পেতে এ অলরাউন্ডারেরও বেশি সময় লাগেনি। একযুগ ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেট ধাপে ধাপে উপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন এই পাঁচ সিনিয়র মিলে। নিরন্তর ছুটেও তারা ক্লান্তিহীন। কীভাবে আরও ভালো খেলা যায়, বেশিদিন দেশের হয়ে অবদান কীভাবে রাখা যায়; সেই প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত। নিভৃতে চলে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সংগ্রাম।
তাদের ছাড়া বাংলাদেশ দল কল্পনা করাও যেন দুঃসাহস! পঞ্চপাণ্ডবের একেকজনের অনুপস্থিতি বিশেষ বিশেষ জায়গায় শক্তি কমিয়ে বাংলাদেশ দলকে দুর্বল করে দেয়। কেউ ইনজুরিতে পড়লে পুরো পাইপলাইন ঘেঁটেও বের করা সম্ভব হয় না কাছাকাছি মানের কোনো বিকল্প। এই বাস্তবতা অভ্যস্ততার পর্যায়ে চলে এসেছে, যেটি আগামীদিনের জন্য হুমকি মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, সিনিয়রদের ছায়া হয়ে না থেকে উল্টো চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো প্রতিভা নিয়ে জাতীয় দলের আগমন এনামুল হক বিজয়, সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, লিটন দাস, তাসকিন আহমেদ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতদের। তুলনায় গেলে পঞ্চপাণ্ডবের চেয়েও বেশি সম্ভাবনা, বেশি সক্ষমতা দেখিয়েছেন তারা অঙ্কুরেই।
দুর্ভাগ্য, স্বপ্নের মতো শুরুর পরও নিজেদের সঠিক রাস্তায় ধরে রাখতে পারেননি এ তরুণরা। লম্বা সময় ধরে আছেন পঞ্চপাণ্ডবের ছায়ায়। টিকে থাকার সংগ্রাম, দল থেকে বাদ পড়ার শঙ্কা তাদের নিত্যসঙ্গী।
ব্যাপারটি ‘ভীতিকর’ উল্লেখ করে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের প্রিয় মেন্টর নাজমুল আবেদিন ফাহিম বলছেন, ‘বিজয়, সাব্বির, মোসাদ্দেক সবাইকে আমরা অনেক আগে থেকে দেখেছি, তাদের সম্ভাবনার কথা আমরা জানি। বিভিন্ন সময় তারা সেটা করেও দেখিয়েছে। ভীতিকর বিষয় হচ্ছে, তাদের এখন যে অবস্থানে থাকার কথা, সেই অবস্থানে নেই। আর বারবারই বলি, আমরা যেভাবে তাদের দেখেছি শুরু থেকে, সেই বিষয়টা ভুল ছিল। আমরা তাদেরকে লিডার হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি না, আবার পরিণত হিসেবেও দেখছি না। আমরা চাই তারা সাকিব বা তামিমদের ছায়ায় বেড়ে উঠবে, যা আদতে ভুল।’
বিকেএসপির সাবেক কোচ নাজমুল আবেদিন নিজেও সাব্বির, মোসাদ্দেক, সৌম্যদের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছেন একটা সময়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘যেটা হওয়া উচিত ছিল, মোসাদ্দেকের উচিত ছিল সাকিবের চাইতে এখন ভালো ব্যাটিং করা। সাব্বিরের উচিত ছিল তামিমের চেয়ে ভালো ব্যাটিং করা। তারা যদি ভালো খেলে তাহলে আমরা আরেকটা উচ্চতায় যেতে পারি।’
‘কিন্তু এমনটা হয়নি। তারা অনেক মেধাবী, এখনকার ক্রিকেটারদের চাইতেও অনেকে মেধাবী। কিন্তু তাদের গড়ে তোলায় ভুল আছে। তাদের মধ্যেও আমি কোনো ব্যক্তিগত উদ্যম দেখি না। কেননা সাকিব, তামিম রিয়াদদের দেখেছি তারা কী পরিশ্রমী ছিল। জাতীয় দলকে ভালো উচ্চতায় নিতে অনেক পরিশ্রম করেছে, নিজের জন্য না কিন্তু। এখনকার যারা তরুণ তাদের মধ্যে ওই স্পৃহাটুকু নেই। এই দায়বদ্ধতা তাদের একার না, আমাদেরও। আমরা তাদের মধ্যে নেতাসুলভ কিছু দেখতে চাইনি বা তাদের সেভাবে গড়ে তুলিনি।’
দেশের আরেক খ্যাতিমান কোচ সারোয়ার ইমরান মনে করেন এখন তরুণদের থেকে ভালো আউটপুট পেতে হলে দিতে হবে বড় দায়িত্ব। যেটি শুরু করতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেই।
‘লোকাল ক্রিকেট থেকে শুরু করতে হবে আমাদের। কিছু কিছু জিনিস ভালো করতে হবে। সঙ্গে আম্পায়ারিংয়ের মানও বাড়াতে হবে। আরেকটা জিনিস হচ্ছে তাদের(তরুণদের) যদি সব সময় জুনিয়র হিসেবেই মনে করে যাই তাহলে ওরা সামনে আগাতে পারবে না। তাদেরকেও দায়িত্ব দিতে হবে।’
‘উদাহরণ দিতে গেলে বিপিএলে পাঁচজনের জায়গায় চারজন বিদেশি যদি খেলত তাহলে জুনিয়ররা দায়িত্ব নিতে পারত। এ ব্যাপারগুলো আমাদের চিন্তা করতে হবে। আর জুনিয়রদের জুনিয়র হিসেবে ট্রিট করা ঠিক না, তাদেরকে বড় দায়িত্ব দিতে হবে যাতে দেশের জন্য বড় কিছু করতে পারে।’