প্রায় এক যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা, একাধিক মামলায় দলের দুই শীর্ষ প্রধানের সাজা এবং নানা কারণে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বিএনপি এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সঙ্গী করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
গত ১৩ অক্টোবর সংবিধান প্রণেতা ও প্রবীণ রাজনৈতিক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি এবং নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে এই জোটে রাখা হয়নি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারাকে।
মূলত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই চাঙ্গা হয়ে উঠে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে কোণঠাসা বিএনপির নেতাকর্মীরা। ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে সাফল্য পেতে মরিয়া দলটি।
আদৌ কি বিএনপি এই জোট থেকে তাদের প্রত্যাশিত সাফল্য পাবে? নাকি অপূর্ণই থাকবে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন? এ নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের বিশ্লেষণ:
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি কতটা সফল হবে – এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এটা অনেক বড় প্রশ্ন, এতে অনেক বিশ্লেষণের ব্যাপার আছে। অনেক কিছুই এর মধ্যে আছে। তবে বেনিফিট না হলে আমরা গেলাম কেন? ঐক্য করলাম কেন?
‘‘এই ঐক্যের ডাক তো আমরাই দিয়েছি প্রথমে। জাতীয় ঐক্য আনতে হবে, স্বৈরাচারী সরকারকে সরাতে হলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এটাই তো ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। সুতরাং আমরাই তো এটা চেয়েছি। আমরা মনে করেছি যে, দেশের জন্য, মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হবে এই ঐক্য। এই ঐক্য সব দলের সমন্বয়ে চলবে।’’
অবশ্য বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতৃত্ব বিষয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনকে শীর্ষ নেতা বলার শব্দগতভাবে তাৎপর্যটি অন্যরকম। কারণ তিনি বয়স ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে মোস্ট সিনিয়র লিডার। বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান বা আমাদের মহাসচিবসহ বিএনপিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের সবার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ রাজনৈতিক। সুতরাং সম্মানের জায়গাটা উনি পাবেন। এখন এটাকে কেউ বলে শীর্ষনেতা, কেউ বলেন স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান।’
‘‘ড. কামাল হোসেন নিজেও বলেছেন, জোট চলবে যৌথ নেতৃত্বের ভিত্তিতে। সেখানে উনি সিনিয়র হিসেবে সেটা উনাকে দিতেই হয়। এটি মূল্যবোধের ব্যাপার। আর উপকৃত হওয়ার বিষয়টি জনগণের উপর নির্ভর করছে। জনগণকে নিয়েই বিএনপির লক্ষ্য। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখাই আমাদের মূল লক্ষ্য। সেখানে সাধারণ মানুষ মূল ফ্যাক্টর। জনগণ বর্তমান সরকারের উপর অসন্তুষ্ট।’’
ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হতে বিএনপি সঠিক পথে আছে মন্তব্য করে আলাল আরো বলেন, ‘‘যাকে যাকে বন্ধু করা দরকার, সেটা আমরা করছি। মনে হচ্ছে আমরা সঠিক পথে আছি। এই সঠিকতার মধ্যদিয়েই আমরা একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য, অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাই।’’
নির্বাচনে জিতে যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে এবং বেগম খালেদার যদি মুক্তি হয় তখন জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা হবে বলে জানান বিএনপির এই নেতা।
তিনি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া ২০৩০ ভিশন দিয়েছিলেন। সেটাতে ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যাপারে বলা আছে। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে ক্ষমতার অসমাঞ্জস্যতা রয়েছে সেটাকে ভারসাম্য করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ওই ভিশনে। এছাড়া দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাব আছে। যেখানে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উচ্চক্ষক গঠন করা এবং বর্তমান সংসদ।’
তিনি মনে করছেন, বিএনপির এতে ক্ষতির কিছু নেই। বিএনপির এই নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনকে বিএনপির জন্য স্বার্থকতাই হিসেবেই দেখছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী এই জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট না হলেও তা বিএনপির জন্য কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করতে পারে বলে মন্তব্য করে বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ ভোটের রাজনীতিতে কতোটা সফল হবেন তা বলতে না পারলেও এটা সত্য যে, তারা জনগণের কাছে খুব পরিচিত। আর যাইহোক এই ঐক্য বিএনপির জন্য পায়ের তলায় মাটি পাওয়ার মতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদারের মতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যাওয়া এবং ড. কামালের নেতৃত্বে থাকা বিএনপির জন্য একটি স্মার্ট সিদ্ধান্ত। কেননা, এর মধ্যদিয়ে বিএনপি উপর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তথা জামায়াতের সম্পৃক্তার জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার কিছুটা সুবিধা পেয়েছে।
‘‘জামায়াতের সম্পৃক্ততার ফলে বিএনপি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেভাবে সুবিধা পাচ্ছে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে ট্যাগ অবস্থায় থাকা বিএনপির জন্য বড় ক্ষতি। অন্যদিকে ২১ আগস্টের মামলার রায় হয়ে গেছে। রায় বিষয়ে তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অবগত। এমতাবস্থায় বিএনপির আসলে এটাই একমাত্র বিকল্প। তারা এই পথে আসতে বাধ্য হয়েছে। যদিও ড. কামাল এবং অন্য যারা আছেন ভোটের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান নেই। কিন্তু তাদের ফেসভ্যালু আছে। বিএনপি সেটাকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের কাছে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে।’’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেনসহ অন্যদের ঐক্য তৈরির পেছনে কোনো অশুভ উদ্দেশ্য দেখছেন।
তার মতে, বিএনপি কতোটা সফল হবে সেটা আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেনসহ অন্যদের মতাদর্শগত কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের মধ্যে ঐক্য হওয়ার কথা নয়। যাদের এক হওয়ার কথা না, তারা যখন এক হয় তাহলে ধরে নিতে হবে যে তাদের কোনো অশুভ উদ্দেশ্য রয়েছে।
হারুন অর রশিদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘সাধারণত সরকার গঠন করার পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সমমনা দলগুলো ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে থাকে। যাদের একই আদর্শ, একই লক্ষ্য। তবে পলিসিগত পার্থক্য থাকে। কিন্তু এই ঐক্যফ্রন্টে যারা আছেন তাদের নিজ নিজ দলের মেনুফেস্টো, বক্তৃতা, বিবৃতি একেবারেই বিপরীতমুখী। আদর্শের সাথে কোনো ধরনের মিল নাই।’
‘‘ড. কামাল হোসেন সাহেব বঙ্গবন্ধুর নামে অতিভক্তির ভাব দেখান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তি নন, সেটা একটি আদর্শ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ না করে তাকে শ্রদ্ধা করা যায়, তা বিশ্বাস করি না আমি। বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বাস করতে হলে মুক্তিযুদ্ধরে সপক্ষে থাকতে হবে। যে শক্তি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে সেই জামায়াতের বন্ধু যে বিএনপি তাদের মতাদর্শ একই (জামায়াত আর বিএনপির মতাদর্শ)। জামায়াত নির্ভর বিএনপির সঙ্গে কামাল হোসেনের কিভাবে ঐক্য হলো সেটা আমি বুঝতে পারছি না।’’
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, এই ক্ষেত্রে বিএনপি কতোটা লাভবান হবে এটা বিবেচনার বিষয় নয়। আসল কথা হলো বিপরীতমুখী এই শক্তিগুলো এক হয়েছে। তাদের কোনো অশুভ উদ্দেশ্য আছে।