চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ডায়রিয়া ও চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে হাওরাঞ্চলের মানুষ

হঠাৎ ডায়রিয়া শুরু হওয়ায় নেত্রকোণার মদনপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হতে করা হয়েছে আট মাসের শিশু শুভ হাসানকে। শিশুটির এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে হাওরের দূষিত পানিকেই দায়ী করলেন শিশুটির স্বজনরা।

শুভ হাসানের মতো ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে লিজাও। চিকিৎসার জন্য ১৪ মাস বয়সী শিশুটি ভর্তি রয়েছে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে। শিশুটির মা বলেন, ‘হাওরের পানি না খেলেও বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে হয়। এজন্য ডায়রিয়া হবে বলে ভাবিনি। কিন্তু বাসায় টিউবওয়েলও নেই। খাওয়ার পানি অন্য বাড়ির টিউবওয়েল থেকে আনা গেলেও সব কাজের জন্য তো আর যাওয়া যায় না।’

সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোর ডট কম জানিয়েছে, শুধু ডায়রিয়া নয়, চর্মরোগসহ পানিবাহিত আরো বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে হাওরাঞ্চলের দুর্গত এলাকাগুলোয়। আক্রান্ত এলাকাগুলোয় দুর্গতদের জনস্বাস্থ্যের জন্য এখন বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্যার দূষিত পানি।

সুনামগঞ্জের করচার হাওর ডুবে যাওয়ার পর কোমর উচ্চতার পানিতে নেমে টানা তিনদিন ধরে ধান কেটেছেন বিশম্বরপুরের পলাশ ইউনিয়নের পদ্মনগর গ্রামের দিনমজুর আবদুল কাইয়ুম। এর পর থেকে তার হাতে-পায়ে ছোপ ছোপ দাগ হয়ে রয়েছে। আরো অনেকেরই এমন খোস-পাঁচড়া হয়েছে ধান কাটার পর।

ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাওরাঞ্চলের হাসপাতালগুলোয় বর্তমানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রাতারাতি রোগী আগমনের হার বেড়ে যাওয়ায় স্থানসঙ্কুলান হচ্ছে না হাসপাতালগুলোর মেঝেতেও। একইসঙ্গে শিশুদের মধ্যেও হামের প্রকোপ বেড়েছে।

অন্যদিকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব আরো মারাত্মক আকারে দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে এ পরিস্থিতি দেখা দেয়ারে সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত প্রতিরোধের জন্য সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর সিভিল সার্জনরা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে নেত্রকোনা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. আবদুল গনি বলেন, এখন পর্যন্ত অস্বাভাবিক কোনো রোগী দেখা যায়নি। ডায়রিয়া, পেটের পীড়া ও চর্মরোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়েছে। তবে যখন পানি নেমে যাবে, তখন ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিতে পারে। সেজন্য মেডিকেল দলকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও খাবার পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, স্যালাইন ও ওষুধ মজুদ করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলেই যাতে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যায়, সে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করে রেখেছি।

সুনামগঞ্জ জেলা সদরসহ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় খবর নিয়ে জানা গেছে, জেলায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়ার পর এসব হাসপাতালে মোট রোগীর সংখ্যা বেড়েছে আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ। বিশেষত গত দু-তিনদিনে ব্যাপক হারে বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। এসব হাসপাতালের রোগী, চিকিৎসক, নার্স ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে; বন্যা শুরুর পর থেকেই এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ২৩ এপ্রিল সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে ২০ জন। এছাড়া ভর্তি হয়েছে হামে আক্রান্ত চার শিশু। হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নিয়েছেন নয়জন। অন্যদিকে গতকাল এখানে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩০। এছাড়া আউটডোরে চিকিৎসা নিয়েছেন আরো ৩২ জন।

ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২ তারিখে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ছয়জন, হামে পাঁচজন ও পেটের পীড়াসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৩ জন। অন্যদিকে গতকাল এখানে মোট ভর্তি হয়েছেন ৩০ জন।

নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে ২১ এপ্রিল চিকিৎসা নিয়েছিলেন ৩৯২ জন। আর ওই দিন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১৮৭। সেখান থেকে গতকাল আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯২ জনে। ভর্তিও বেড়ে ২০১ জনে দাঁড়িয়েছে।

জেলাটির মোহনগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে ২১ এপ্রিল চিকিৎসা নিয়েছিলেন ১০৯ জন রোগী। তিনদিনের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে গতকাল এখানে চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৮তে। একই হারে বেড়েছে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাও।

বর্তমান দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানান সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাশ। তিনি বলেন, জেলার ৮৭টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।

এসব টিম হাওরের পানি ব্যবহার থেকে মানুষকে বিরত রাখায় কাজ করছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে পানিবাহিত রোগ সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। যাদের বাড়িতে টিউবওয়েল নেই, তাদের ফুটিয়ে ও বিশুদ্ধকরণ বড়ি দিয়ে বিশুদ্ধ করে পানি খেতে বলা হচ্ছে।

চিকিৎসকরা জানান, মূলত দুর্গত এলাকা হওয়ার কারণে এসব এলাকার শিশুরা সঠিকভাবে টিকা নিতে পারেনি। এ কারণে এখন হামে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।

হাম প্রতিরোধের পদক্ষেপ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা সিভিল সার্জন বলেন, বায়ু দূষণের কারণে এ বছর হামে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। রোগটির প্রকোপ সাধারণত নয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত হামে আক্রান্ত ১২০ শিশুর চিকিৎসা করেছি। এছাড়া ২৯ এপ্রিল থেকে ১৪ মে পর্যন্ত জেলার ৩ লাখ শিশুকে এমআর টিকা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন এ কার্যক্রম চালু থাকবে।