নিজ ভূমিতে ফেরার দাবিতে ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন বা প্রত্যাবর্তনের জন্য মহাযাত্রা’ নামে টানা ৭ সপ্তাহ ধরেই বিক্ষোভ চলছে গাজা সীমান্তে। প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছেন নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে শুধু সোমবারই প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি। হাসপাতালে আহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা প্রায় চার হাজার। অন্যদিকে, বৈরিতা ভুলে ঐক্যের সরকার গঠনে তোড়জোড় শুরু করেছে গাজা নিয়ন্ত্রিত হামাস ও পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাহমুদ আব্বাসের পিএলও। অনেকেইর শঙ্কা জেরুজালেম ইস্যুতে এখন ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনিরা ডাক দিতে পারেন তৃতীয় ইন্তেফাদা।
তিন ধর্ম ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি সকলেরই কাছেই জেরুজালেম পবিত্র নগরী। ইসলাম ধর্মমতে, মুসলিমদের অন্যতম ধর্মীয় স্থান আল-আকসা; জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদ আল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মহানবী হযরত মুহম্মদ (স) মেরাজে গিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ইহুদিরা মনে করে, এখানেই তাদের আদি নিবাস। ইহুদিদের পবিত্র ভূমিখ্যাত টেম্পল মাউন্ট বা ঈশ্বরের ঘর, যা মুসলিমদের কাছে পবিত্র কুব্বাত আস-সাখরা। টেম্পল মাউন্টকে ঘিরে থাকা ওয়েস্টার্ন ওয়াল ইহুদিদের কাছে পৃথিবীর ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে স্বীকৃত। আবার যিশুখ্রিস্টের বহু স্মৃতিবিজড়িত গির্জার কারণে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছেও পবিত্রতার দিক থেকে সমান গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, জেরুজালেমের বেথেলহামে যিশুর জন্ম আর এই শহরেই ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিল যিশুকে।
গেলো ডিসেম্বরে এই পবিত্র নগরীকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ঘোষণা অনুযায়ী ১৪ মে থেকে তেলআবিবের পরিবর্তে মার্কিন দূতাবাসের কার্যক্রম চলবে জেরুজালেম থেকে। মার্কিন মদদপুষ্ট অনেক দেশই ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পক্ষে সায় জানিয়েছেন। এতদিন তলে তলে ইসরায়েলকে প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও সৌদি আরবের নতুন উত্তরসূরি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান অনেকটা প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া উচিত ইসরায়েলের। একই পথে হেঁটেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতও। যা ক্ষুব্ধ করেছে অনেক মুসলিম দেশকে।
সমগ্র জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিন দখল করে মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার ইসরায়েলি নীলনকশা বহুদিনের। ভূমধ্য সাগরের তীর থেকে জর্ডান নদীর পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত সে রাষ্ট্রের বিস্তৃতির লক্ষ্যে ইহুদিবাদীরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। তারা মনে করে,এ নীলনকশা বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে থাকলেই যথেষ্ট। ইসরায়েলের বাইরে বিশ্বে ইহুদিদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাঁটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস কিংবা গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ফেডারেল রিজার্ভ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, মুদ্রাবাজার বাণিজ্য ও বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান সবই ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্টই তাদের অসামান্য প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না।
বিশ্বের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহর জেরুজালেমকে অনেকেই বলেন পৃথিবীর কেন্দ্র। কারণ এর পূর্বে এশিয়া, পশ্চিমে ইউরোপ আর দক্ষিণে আফ্রিকা মহাদেশ। এই অঞ্চলে মানব বসতি প্রায় সাত হাজার বছর আগে। এই অঞ্চল শাসন করেছেন মিসরীয়, ব্যবিলিনীয়, রোমান ও পারস্য সম্রাটেরা। ইহুদিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে তাদের পূর্বপুরুষদের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ দাবি করে। ইসরায়েলিদের দাবি, প্রায় তিন হাজার বছর আগেও সেখানে তাদের একটি রাষ্ট্র ছিল, যার রাজধানী ছিল পবিত্র জেরুজালেমে। কিন্তু খ্রিস্ট জন্মের কিছুটা সময় পর থেকে সেখানে বিভিন্ন প্রশাসনিক কারণে রোম সম্রাটদের হস্তক্ষেপ নেমে আসে তাদের ওপর।
বলা হয়, খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছরে জেরুজালেমকে ইহুদি রাজা দাউদের রাজ্যের রাজধানী করা হয়েছিল। পরে তাঁর পুত্র সুলেইমানের সময়ে সেখানে তাদের ফার্স্ট টেম্পল নির্মাণ করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৯৩০ বছরে দাউদ ও সুলেইমানের সে রাজ্য ভাগ হয়ে উত্তরে ইসরায়েল ও দক্ষিণে জুডা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সে রাজ্যগুলো ইহুদি অধ্যুষিত ছিল না। আদি ফিলিস্তিন মূলত বর্তমানে ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চল, জর্ডান,লেবানন ও সিরিয়ার কিছু অংশ।
এ জনপদে বেশ কয়েকজন নবীর আগমন ঘটেছিলো। হজরত ইবরাহিম, ইয়াকুব, মুসা, দাউদ, সুলেইমান, ঈসা (আ:) তাদের মধ্যে অন্যতম। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা:) ও সফর করেছেন এ নগরী। পবিত্র কিতাব তৌরাত, বাইবেল ও কোরআনেও জেরুজালেমের অনেক ঘটনার বর্ণনা আছে। হিব্রু বাইবেল, খ্রিস্টান বাইবেল (ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট) এবং পবিত্র কোরআনে এ অঞ্চলের বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। এ অঞ্চলকে ‘ল্যান্ড অব হিব্রুজ’ ও ‘প্রমিজড ল্যান্ড’ এবং পবিত্র কোরআনে এ ভূমিকে ‘আল-আরদ আল-মোকাদ্দাস’ অর্থাৎ পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত কাবা শরিফের দিকে নামাজের কিবলা পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাসই ছিল মুসলমানদের প্রথম কেবলা। পবিত্র মেরাজের রাতে অর্থাৎ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এ জেরুজালেম থেকেই নভোমণ্ডলের উচ্চস্তরে সফর করেন।
এ পবিত্র ভূমিতে ৬৯১ সালে খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যা ‘ডোম অব দ্য রক’ নামে পরিচিত। এর এক দশক পর খলিফা আল ওয়ালিদ-১ ‘আল-আকসা’ নামে আরেকটি প্রসিদ্ধ মসজিদ নির্মাণ করেন। তা ছাড়া আরব ব-দ্বীপের এ অঞ্চল বিজয়ের পর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন ইবন খাত্তাব জেরুজালেম সফরে এলে তাঁর হাতে নগরীর চাবি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। পরে খলিফা ওমর (রা.) সেখানে একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এর আগে যিশুখ্রিস্টর অন্তর্ধানের পর জেরুজালেমে ‘হলি সেপলকর’ নামে একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়।
ভূমধ্য সাগর ও লোহিত সাগর সংলগ্ন এ সমৃদ্ধ অঞ্চলে পারস্য, গ্রিক, রোমান ও মিসরীয়সহ বহু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর্যুপরি আগমন ঘটেছে। তারা এ জনপদে সাম্রাজ্য বিস্তার করে আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যেমন বাণিজ্যকে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেছে, তেমনি নৌঘাঁটি স্থাপন করে তাদের সাম্রাজ্যের অবস্থানকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে বারবার। খ্রিস্টীয় যুগের দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রথম ও দ্বিতীয় ইহুদি বিদ্রোহের পর রোমান সম্রাট হাড্রিয়ান ইহুদিদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। তা ছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ৬০৪ সালে আসিরীয় সেনারা ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের নির্দেশে বহুসংখ্যক ইহুদিকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে জুডা ব্যাবিলনীয়রা জয় করে নেয় এবং তারা জেরুজালেমে নির্মিত প্রথম ইহুদি মন্দিরটি ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে এখানে পারস্যের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করলে এ ভূখণ্ডে ফেরার সুযোগ পায় ইহুদিরা। খ্রিস্টীয় যুগের আগে ও পরে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী এ অঞ্চল শাসন করেছে। ৬৩৮ থেকে একটানা ১০৯৯ সাল পর্যন্ত চলেছিল আরব খলিফাদের শাসন।
মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধারকল্পে ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা, ১০৯৯ থেকে ১১৮৭ সাল পর্যন্ত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ চালায়। সে সময় ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা এ অঞ্চল দখল করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে কুর্দি সেনানায়ক সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্ব পরাজিত হয় খ্রিস্টানরা। ১১৮৭ সালে ঐতিহাসিক হাত্তিনের যুদ্ধে সম্মিলিত খ্রিস্টান বাহিনীকে পরাজিত করে তাদের প্রিয় নগরী জেরুজালেমসহ অন্যান্য এলাকা দখল করেন। শেষমেশ খ্রিস্টানদের প্রভাবশালী নেতা প্রথম রিচার্ড, মুসলমানদের হাতে জেরুজালেমের সার্বিক নিয়ন্ত্রণভার তুলে দিয়ে ‘পুণ্য ভূমি’ স্থাপনের খ্রিস্টীয় স্বপ্ন ত্যাগ করেন। এরপর এ অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় অটোমান ও মিসরীয় শাসন যা স্থায়ী হয়েছিল ১৯১৭ সাল পর্যন্ত। প্রায় এক হাজার ৩০০ বছর জেরুজালেমসহ এ অঞ্চল মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল। সে সময়ে আরব মুসলিমরা জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণতও হয়েছিল।
অটোমানদের ৪০০ বছরের শাসন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরই ধসে পড়ে। ১৯১৭ সালে জেরুজালেম দখলে নেওয়ার পর তিন দশক ব্রিটিশরা এখানে শাসন করে। জায়নবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক লাখ ইহুদি শহরটিতে পাড়ি জমাতে থাকে তৎকালীন ব্রিটিশ অধ্যুষিত প্যালেস্টাইনে। যেখান থেকেই বিরোধের সূচনা। স্থানীয় মুসলিমদের সঙ্গে কয়েকবার দাঙ্গা বাধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। একটি হবে ইহুদিদের রাষ্ট্র, অন্যটি আরব ফিলিস্তিনিদের। ওই সিদ্ধান্তমতে, জেরুজালেম শাসিত হওয়ার কথা একটি আন্তর্জাতিক বিশেষ কাঠামোতে। আরবরা ওই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। ইসরায়েল ১৯৪৮ সালে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। একে স্বীকৃতিও দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে এ ঘটনার একদিন পরই আরব প্রতিবেশী দেশগুলো আক্রমণ করে ইসরায়েলকে। তবে এ লড়াইয়ে পরাজিত হয় আরবরা। যুদ্ধের পর পশ্চিম অংশ দখলে নেয় ইসরায়েল। ১৯৫০ সালে ইসরায়েলের নতুন আইন অনুযায়ী, পশ্চিম জেরুজালেম হয়ে ওঠে তাদের রাজধানী। অন্যদিকে পূর্ব জেরুজালেম, যেখানে পবিত্র ওল্ড সিটি ছিল, তা ছিল জর্ডানের দখলে।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনে যুদ্ধে ইসরায়েল শুধু আরব দেশগুলোকে পরাজিতই করেনি, তারা মিসরের কাছ থেকে গাজা তীর ও সিনাই উপত্যকা দখল করে নেয়। জর্ডানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম।
১৯৭৭ সালে ইসরায়েলের ক্ষমতায় আসে কট্টর ডানপন্থী লিকুদ পার্টি। এরপরই তারা ইহুদি জাতির সঙ্গে জেরুজালেমের সম্পর্ককে অবিচ্ছেদ্য হিসেবে প্রচার করে। ফলে জেরুজালেমের গুরুত্ব ইহুদিদের কাছে আরও বেড়ে যায়। এরপর মুসলিমদের জন্য শহরের আল আকসা সংলগ্ন অংশে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ শুরু হয়। কয়েক দফায় সহিংসতা, গণঅভ্যুত্থান ও আন্তর্জাতিক চাপেও ফিলিস্তিনিদের কাছে জেরুজালেমের দখল ছাড়েনি ইসরায়েল। ধর্মীয় ও ভৌগৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায়, পূর্ব জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে আসছে ফিলিস্তিনিরা। জেরুজালেম দুই অংশে বিভক্ত। পূর্ব জেরুজালেমে ইসলামের তৃতীয় পুণ্যস্থান মসজিদুল আকসা অবস্থিত। আল-কুদস নামে আরবদের কাছে পরিচিত পূর্ব জেরুজালেমে স্বাধীন ফিলিস্তিনের রাজধানী করার পূর্ব ঘোষণা ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের ঘোষণায় পূর্ব কিংবা পশ্চিম কিছুই উল্লেখ না করে জেরুজালেম নগরীর নাম উল্লেখ করায় এক নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
১৯৪৭ সাল থেকে জেরুজালেম নগরী নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১০টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাস হয়েছে। এতে জেরুজালেম নগরীর অবস্থানকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চূড়ান্ত আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সেগুলো পাশ কাটিয়ে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে গৃহীত এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের ঘোষণা দেন। ৫৭ দেশের মুসলিম সংস্থা ওআইসি অবশ্য, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী আহ্বান জানিয়েছে। ট্রাম্পের ঘোষণাকে অকার্যকর করতে ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে ওআইসির হয়ে সদস্য দেশ মিসর এক জরুরি সভা আহ্বান করেছিলো। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ ভোট পেয়েও, কেবল মার্কিন ভেটোর কারণে প্রস্তাবটি পাস হয়নি।
ফিলিস্তিনিরা কোনো দিনই জেরুজালেমের দখল মেনে নেয়নি। গেল ৭০ বছরে পূর্ব জেরুজালেমের বহু জায়গায় ইহুদি বসতি বানিয়েছে, ইসরায়েল। তার পরও এখানকার সিংহভাগ বাসিন্দা ফিলিস্তিনি, যারা বহু বছর ধরেই এই শহরে বসবাস করছে। তারা চায়, পূর্ব জেরুজালেম হবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। ফিলিস্তিনি নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণাকে কবর দিয়ে দেওয়া। এ বছরও হামাস নেতারা জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করে ফিলিস্তিনের সীমারেখা প্রস্তাব করেন, কিন্তু ইসরায়েল তা নাকচ করে দেয়। নতুন করে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস।
মার্কিন তাত্ত্বিকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মূলত ঈভানজেলিকল খ্রিস্টান বা প্রটেস্টানদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে কেবল যিশু খ্রিস্টের ওপর বিশ্বাস রাখলেই আত্মার ত্রাণ হতে পারে তাদের খুশি করতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নির্বাচনী অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন। ১৯৯০ সাল থেকে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের নেতারা জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী এবং মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করার অঙ্গীকার করলেও কেউই ক্ষমতায় গিয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করেননি। সকলের ভয় ছিলো এতে যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। এমনকি জর্জ ডাব্লিউ বুশও ইসরায়েলিদের পছন্দের নেতা ছিলেন। তারপরও তিনি ঝুঁকি নেননি। ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে কট্টর ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের বড় ভূমিকা আছে। অর্থাৎ ইসরায়েলই এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। সেই ইসরাইলকে খুশি করতেই ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত।
ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রভাবিত করেছেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিক্কি হ্যালি। পেন্স কেবল ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েই ক্ষান্ত থাকবেন না। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তিনি এই গোষ্ঠীকে হাতে রাখতে চাইছেন। তিনি সম্প্রতি ইহুদিদের একটি অনুষ্ঠানে জেরুজালেম ইস্যুর সমাধান করার অঙ্গীকার করেছিলেন। হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। নিক্কি হ্যালির সাউথ ক্যারোলিনার গভর্নর হওয়ার ক্ষেত্রে ঈভানজেলিকল খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের বড় ভূমিকা আছে। তিনিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। বলা হয়, ট্রাম্প মূলত কট্টরপন্থীদের খুশি করতেই জেরুজালেম ইস্যুতে এতো কঠোর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে ট্রাম্প কন্যা ইভানকার ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনারেরও প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছিলো জেরুজালেম ইস্যুতে বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে। এমনকি ইসরায়েলের তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন ইভানকা ও জ্যারেড কুশনার। কেবল ফিলিস্তিনিদের সহায়তা দেয়ার দায়ে এরই মধ্যে সৌদি জোটের বিরাগভাজন হয়েছে কাতার। বলা হয় ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর চাপেই জিসিসি থেকে বহিষ্কার ছাড়াও কাতারের বিরুদ্ধে জল, স্থল ও আকাশপথে অবরোধ আরোপ করেছে সৌদিসহ ৫ দেশ।
এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মেরুকরনে ইরানের আধিপত্য আরও বেড়েছে। কাতার, ইরান, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও তুরস্ক নিয়ে নতুন ইরানি ব্লক এখন ব্যাপক প্রভাবশালী এ অঞ্চলে। বিশ্লেষকদের ধারণা, জেরুজালেম নিয়ে ট্রাম্পের অযাচিত পদক্ষেপে রক্তপাতে আরো বাড়বে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে আমেরিকা বিদ্বেষ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)