জাপানের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা শিনজো আবের জোট গত সোমবারের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেছেন। যার মাধ্যমে তিনি দেশটিকে দীর্ঘদিনের ‘শান্তি সংবিধান’ থেকে বের করে আনার সুযোগ পাচ্ছেন।
নর্থ কোরিয়ার ক্রমাগত হুমকির মধ্যে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার আগেই আবে জাপানের শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে সেনাবাহিনীকে নতুন করে সাজানোর বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই পদক্ষেপকে ‘পুর্নসামরিকীকরণ’ উল্লেখ করে এর তীব্র সমালোচনাও হয়েছে।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর টোকিওতে এক সংবাদ সম্মেলনে এই জয়কে জনগণের ‘বিশ্বাসের প্রতিফলন’ হিসেবে উল্লেখ করেন আবে। এই সফলতার পেছনে তাদের শান্তিনীতির বিরোধী প্রচারণা কাজ করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এসময় তিনি বলেন, ‘এর উপর ভিত্তি করে আমরা নর্থ কোরিয়ার হুমকির নাটকীয় জবাব দেবো।’
এমন প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, আবের তৃতীয় মেয়াদে কি জাপান তার শান্তি সংবিধান বা যুদ্ধ বিরোধী নীতি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসবে। পুর্নসামরিকীকরণের মাধ্যমে এবার তাহলে কি জাপানের শান্তির যুগের অবসান হচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে কিছু বিষয় জেনে নেয়া দরকার।
কেন তাদের সেনাবাহিনী নেই?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে পারমাণবিক বোমায় আক্রান্ত হওযার প্রেক্ষাপটে দীর্ঘস্থায়ীভাবে দেশটির জনগণ শান্তিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এরপর সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক বিবাদ মেটাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যা কার্যকর হয় ১৯৪৭ সালের ৩ মে থেকে।
কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের নিকটবর্তী হওয়ায় ভৌগোলিক কৌশলগত কারণে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব মৌলিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর কথা ভাবতে হয় দেশটিকে। এর ভিত্তিতে দেশটি কার্যকরী সেনাবাহিনী গঠন করে যা জাপান সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্সেস (এসডিএফ) নামে পরিচিত। যদিও এদের ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরে উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয় এবং যে কোন ধরনের আন্তর্জাতিক সামরিক সংযুক্তি থেকে তাদেরকে দূরে রাখা হয়।
এখন কী অবস্থা?
২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিনজো আবে দেশটির ক্ষমতায় আসার পরপরই তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা দেশটির সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত স্ব-আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে একটি প্রস্তাব পাস করেন। যার মাধ্যমে দেশটির সেনাবাহিনী সমষ্টিগত আত্মরক্ষার অধিকার চর্চা বা আক্রান্ত কোনো বন্ধুভাবাপন্ন দেশকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার সুযোগ ফিরে পায়।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে দেশটির মন্ত্রীসভা সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদকে এড়িয়ে গিয়ে এই প্রতিরক্ষা বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেয়। এ দেশটির নিরাপত্তা নীতিতে বড় পরিবর্তন এনে একটি বিল অনুমোদন করা হয়। যার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো দেশটির সামরিক বাহিনী বিদেশে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়ার অধিকার অর্জন করে।
একে বলা হয়েছিল ‘কালেক্টিভ সেল্ফ-ডিফেন্স’। বিষয়টি ছিল এরকম- যদি জাপানের নিরাপত্তায় নিযুক্ত মার্কিন নৌবাহিনী কোনও কারণে আক্রান্ত হয় তাহলে জাপানের নৌবাহিনী এগিয়ে যেতে পারবে। এ নিয়ে জনগণের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। এই পরিবর্তন আসে মার্কিন-জাপান প্রতিরক্ষা সমঝোতার চুক্তির আলোকে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের দ্বিপক্ষীয় সামরিক কর্মকাণ্ডে বৃহত্তর ভূমিকা রাখার মঞ্চ প্রস্তুত হয়।
দেশটির এক লাখ ৫০ হাজার সুসজ্জিত সৈন্য রয়েছে। যা ন্যাটোর অন্যতম সদস্য ব্রিটেনের থেকে বড়। সেনার আকারে ছোট হলেও অস্ত্র-সস্ত্র দেশটির সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে রেখেছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর দখলে ৬৭৮টি ট্যাংক, ১৫১৩টি উড়োজাহাজ এবং ১৬টি সাবমেরিন রয়েছে। দেশটির বার্ষিক সামরিক ব্যয় ৪১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
একটি হেলিকপ্টার বহনকারী, দুইটি এজিস (উন্নত রাডার প্রযুক্তি ও ক্রুজ মিসাইল সমৃদ্ধ অত্যাধুনিক যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ আশ্রয়), ৩৪ টি যুদ্ধ জাহাজ এবং বিভিন্ন ধরনের ৯টি রণতরীতে সুসজ্জিত নৌবাহিনী রয়েছে।এতে আরও রয়েছে সাবমেরিন বিধ্বংসী ৮০টি অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার। নর্থ কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ক্রমাগত হুমকির মুখে দেশটি ব্যালেসটিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও উন্নতি করছে।
আগামী মাসে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন আবে। নর্থ কোরিয়ার বিষয়ে সেখানে কথা বলবেন তিনি। এরপর চীন ও রাশিয়ার সঙ্গেও আলোচনা হবে। নর্থ কোরিয়ার উপর কঠিন চাপ সৃষ্টি করা হবে উল্লেখ করে আবে বলেছেন, ‘আমি জাপানিস নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো এবং আমার জাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।’
আবের প্রস্তাবিত জাতীয় সেনাবাহিনী কেমন হবে?
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর যে বাহিনী নিয়ে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করেছিলো, মজার বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে তার চেয়ে কয়েকগুণ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী তৈরি করে নিতে সাহায্য করেছে। আবে যে সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব করেছেন তা কেমন হবে তা নিয়ে আবে নিজেই আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন সময়ে।
ভবিষ্যতে দেশটির সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্সেস (এসডিএফ) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি জাপানের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বের যেকোনো রাষ্ট্রের বাহিনীর সঙ্গে এক সঙ্গে কাজ করতে পারবে। যদিও এই ব্যাখ্যা দেশটির সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং আবে চাইলে এখন যে কোনো কিছুই করতে পারেন। কার্যত সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে দীর্ঘদিনের বন্ধু রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক বিষয়ে সম্পর্ক অনেকদূর এগিয়েছে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিটারি অনুশীলনে অংশগ্রহণ জাপানি সৈন্যদের এখন প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ইউএস-ইন্ডিয়ান নাভাল ম্যানুভার্সে জাপানি সৈন্যরাও অংশ নেন। দেশটির সেনাবাহিনীর একটি দল এখনও ইউএস-অস্ট্রেলিয়ান টালিসম্যান সাবরে অনুশীলনে রয়েছেন। কয়েক বছর ধরে আবে জাপানের সেনাবাহিনীকে একটু একটু করে পুনর্গঠন করেছেন। ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ এখনও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
নিরবে-নিভৃতে আবে জাপানের সামরিক শক্তিকে সুসজ্জিতক করেছেন। এটি এখন ওপেন সিক্রেট। ঘোষণা দিয়ে একটি শক্তিশালী ও কার্যকরি আন্তর্জাতিক মানের সেবাবাহিনী গড়ে তোলাটা আবের জন্য এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিভাবে হবে?
ইতেমধ্যে জাপান অন্যতম প্রতাপশালী সেনা ক্রিড়ানক হিসেবে নতুন করে আর্বিভূত হয়েছে। উচ্চাভিলাষী আধুনিকায়ন পরিকল্পনাসহ জাপানের রয়েছে সুসজ্জিত বিমান, নৌ এবং স্থল বাহিনী। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নও আর নেই, কিন্তু উঠতি শক্তি চীন এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্থানে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে টোকিও এবং ওয়াশিংটন প্রতিরক্ষা সমঝোতায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কাজেই এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকরী বন্ধু জাপান। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবশালী সেনা শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশটি তার নিজস্ব সেনাবাহিনীরও আধুনিকায়ন করেছে।
দেশটির সংবিধানের ৭০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এক ভিডিও বার্তায় আবে বলেছিলেন, ‘আমার প্রজন্মের সময়েই আমি সংবিধানে আত্ম-প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করে যাবো এবং এই বাহিনী যে অসাংবিধানিক এ বিতর্ক কোনও স্থান পাবে না। আমি আশা করছি ২০২০ সালে জাপান নতুনভাবে যাত্রা শুরু করবে।’
সেনাবাহিনী গঠনের বিরোধীতা করা সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদ সংশোধনের পক্ষে শিনজো আবে অনেক কথা বলেছেন। ক্ষমতায় এসে আবে সংবিধানের এই নিয়ম পরিবর্তনের বিষয়ে জনগণের মধ্যে জনমত গঠন করতে চেষ্টা করেন। এই অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের জন্য সংসদের উভয় কক্ষের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন লাগবে সঙ্গে লাগবে একটি গণভোট।
যা বর্তমানের আবে ও তার জোটের রয়েছে। সুতরাং, এখন প্রশ্ন হচ্ছে আবে কি সত্যিই জাপানের যুদ্ধবিরোধী সংবিধানের অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তাব তুলবেন? জাপানের মানুষও কি এই গণভোটে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেবেন? উত্তর হচ্ছে- আবের জন্য এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র।