শ্বাশ্বত জীবন-ব্যবস্থা ইসলাম, যাতে মানবজাতির অমীমাংসিত কোন বিষয়ের স্থান নেই। ধনী-দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই পরমযত্নে জাকাতকে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বিত্তশালীগণ যদি সঠিক পরিমাণ ও সঠিক পদ্ধতিতে জাকাত প্রদানে এগিয়ে আসতেন, এদেশে দরিদ্রের হার ধারাবাহিকভাবে নিম্নগামীই হতো। কিন্তু আমাদের দেশে লক্ষ্য করা যায় কেবল রমজান আসলেই বিত্তশালীগণ নামমাত্র জাকাত প্রদান করেন। জাকাত ব্যবস্থার এ অসম বণ্টনের ফলে স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে বিপুল ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আর অন্যপ্রান্তে দরিদ্রের বিরাট একটি অংশ দারিদ্রের অভিশাপের বোঝা নিয়ে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামছে। ধনীদের আকাশচুম্বী প্রাসাদের সামনে রমজানে জাকাত প্রদান অনুষ্ঠানে দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের বিশাল সারি এখন নিয়মিত দৃশ্য। জাকাত হল ধনীদের সম্পদে গরীবের অধিকার আদায়ের অনন্য মাধ্যম। জাকাত আদায়ে যেমন পুরস্কার রয়েছে, যথাযথভাবে অনাদায়ে সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণেও রয়েছে চরম শাস্তি।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, “আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না, তাদেরকে কঠিন আযাবের সুসংবাদ প্রদান করুন। সেদিন স্বর্ণ ও রৌপ্য জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। সেদিন বলা হবে, এটাই যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর” (সুরা তওবা ৩৪ ও ৩৫)।
জাকাত অনাদায়ীর শাস্তির ব্যাপারে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “প্রত্যেক স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক যে তার হক (যাকাত) আদায় করে না, ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের বহু পাত তৈরি করা হবে এবং সে সমুদয়কে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। যখনই তা ঠান্ডা হয়ে যাবে তখন পূণরায় তাকে গরম করা হবে। সেদিন, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। যতদিন না বান্দাদের বিচার নিষ্পত্তি হয় তার শাস্তি চলমান থাকবে। অতঃপর সে তার পথ ধরবে, হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে” (সহিহ মুসলিম)।
অন্যত্র নবীজী ইরশাদ করেছেন, “যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে তার জাকাত আদায় করে না, উক্ত মালকে কিয়ামতের দিন তার জন্য বিষধর সাপে পরিণত করা হবে। যার চোখের ওপর কালো দাগ পড়ে গেছে। অতঃপর তা স্বীয় চোয়ালদ্বয় দ্বারা তাকে কামড় মারবে এবং বলবে আমি তোমার ধনভান্ডার, আমি তোমার সম্পদ” (সহিহ বুখারী)। নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য থাকা স্বত্বেও তার জাকাত অনাদায়ের পরিণাম সম্পর্কে হাদিসে পাকে বর্ণিত হয়েছে, “একজন মহিলা নবী পাকের নিকট আসলেন, তার সাথে তার মেয়ে ছিল আর মেয়েটির হাতে ছিল স্বর্ণের দুটি মোটা চুড়ি। নবীজি তাকে বললেন, ‘তুমি কি এর জাকাত দাও?’ সে বলল, না। এরপর মহানবী বলেন, ‘তোমাকে কি এটা আনন্দ দিবে যে, কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে আগুনের চুড়ি পড়িয়ে দিবেন?” (আবু দাউদ)।
অন্যত্র হাদিসে পাকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (র.) বলেছেন, একদা মহানবী আমার নিকট উপস্থিত হয়ে আমার হাতে রূপার বড় বড় আংটি দেখতে পান এবং বলেন, ‘হে আয়েশা! এটা কী? আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার উদ্দেশ্যে সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য তা তৈুর করেছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এর জাকাত দাও? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তোমাকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট (আবু দাউদ)।
ইসলামী শরীয়তে জাকাত অপরিহার্য একটি বিষয়। যারা জাকাত প্রদানে অস্বীকার করে তারা কাফির হিসেবেই সাব্যস্থ হয়। এজন্যই ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (র.) জাকাত অনাদায়কারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি যেসব লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, যারা নামায ও জাকাতের মাঝে পার্থক্য করবে। কেননা জাকাত হল মালের অধিকার। তারা যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় প্রদত্ত উটের রশিটি দিতেও অস্বীকার করে তবে তাদের এই অস্বীকৃতির কারণে আমি তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করব’।