দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন আছে। সেই আইনের আলোকে জর্দাও তামাকপণ্য এবং সে কারণে এই পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু অটোম্যাটিক্যালি এক দারুণ বিজ্ঞাপন হয়ে গেলো হাকিমপুরী জর্দার। দেশীয় গণমাধ্যম তো বটেই, বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরেও বলা হচ্ছে, দেশের শীর্ষ করদাতা হাকিমপুরী জর্দার কাউছ মিয়া।
সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে আমরা অবশ্যই কাউছ মিয়াকে অভিনন্দন জানাই। সেইসাথে কিছু ডেভিল কোয়েশ্চেনও করতে চাই।
১. জর্দার মতো জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী একটি পণ্যের বিক্রেতা যদি দেশের শীর্ষ করদাতা হন, তাহলে এই ভয়াবহ ক্ষতিকর পণ্যের বাজার কত বড়?
২. দেশের ঠিক কী পরিমাণ মানুষ জর্দায় আসক্ত?
৩. যদি জর্দা বিক্রি করে দেশের শীর্ষ করদাতা হওয়া যায় তাহলে দেশের তথাকথিত বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী, বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, লাখ টাকা ফি নেয়া আইনজীবী, হাজার টাকা ফি নেয়া ডাক্তার-যাদের নাম আমরা সব সময়েই শুনি,তারা কী করে একজন জর্দা বিক্রেতার চেয়েও কম কর দেন?
৪. এই সংবাদ যখন গণমাধ্যমে এলো, তা দেখে কি গাউছ মিয়াকে দেশের শীর্ষ শিল্পপতি-ব্যবসায়ী আর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্তারা ঈর্ষা করেছেন নাকি লজ্জা পেয়েছেন নাকি গাউছ মিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছেন?
৫. দেশের করব্যবস্থাপনায় কি বড় ধরনের কোনো ঘাপলা আছে?
বিবিসির খবরে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শীর্ষ ১০০ জনের যে তালিকা প্রকাশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অনেক নামীদামী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীকে পেছনে ফেলে সেখানে শীর্ষ স্থান দখল করেছেন তামাক পণ্য ব্যবসায়ী মো. কাউছ মিয়া। গত বছর যে শীর্ষ দশজনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, সেটির প্রথম স্থানেও ছিলেন তিনি। এর আগেও তিনি শীর্ষ করদাতার পুরস্কার পেয়েছেন।
কাউছ মিয়ার বিভিন্ন ব্যবসা আর জায়গাজমি মিলিয়ে মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে তামাক ও জর্দার ব্যবসা থেকেই তিনি লাভ করেছেন চার-পাঁচশ কোটি টাকা। অন্য ব্যবসায়ীরা কেন তার মতো এত বার সর্বোচ্চ করদাতা হতে পারেন নি – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্য ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। কিন্তু তিনি জীবনে ব্যাংকের টাকা নেননি। বরং ব্যাংকই তার রাখা টাকা খাটিয়েছে বলে দাবি করেন কাউছ মিয়া।
কাউছ মিয়ার এই খবরের পাশাপাশি আমরা আরও একটি সংবাদ পয়লা নভেম্বরের সংবাদমাধ্যমে পাই যেখানে বলা হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী এবার শিক্ষার্থীদেরও কর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৬ কোটি লোকের দেশে যেখানে এখনও ২৫ লাখ মানুষও কর দেয় না, সে দেশে শিক্ষার্থীদের কর দেয়ার এই আহ্বান কতটা সিরিয়াস আর কতটা রসিকতা,তা অর্থমন্ত্রীই ভালো জানেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে আয়কর মেলা-২০১৬ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘কর দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বয়স নেই। আজকাল শিক্ষার্থীরাও ভালো আয় করছে। এখন থেকে তারাও কর দিতে পারে।’ আয়কর দেওয়া বাহাদুরির ব্যাপার বলেও মন্তব্য করেন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক।
এ কথা ঠিক যে আয়কর দেয়া বাহাদুরির ব্যাপার। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ সব ক্ষেত্রে বাহাদুর হতে চাইলেও (যেমন জমি দখল, প্রতিপক্ষকে এলাকাছাড়া করা, নারী ও শিশু ধর্ষণ,মোটর সাইকেল না পেয়ে বাবাকে খুন, ধর্ম অবমাননার গুজবে মন্দির বা বৌদ্ধ বিহারে ভাংচুর আগুন ইত্যাদি) আয়কর দিয়ে বাহাদুর হতে চায় না। বরং ফাঁকফোকর খোঁজে কীভাবে দশ টাকা কম দেয়া যায়।
আবার দেশের করব্যবস্থাপনা এতটাই জনবিরোধী যে, অল্প আয় করা মানুষেরা সঠিক নিয়ম মেনে করযোগ্য পুরো টাকা পরিশোধ করলেও রাঘববোয়ালরা হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দেয়-তাতে কোনো অসুবিধা নাই। আইনজীবী আর কর অফিসের লোকজনের সঙ্গে সখ্যতা থাকলেই হয়। যদিও আজকাল কর অফিসের লোকজনও দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এটা ভালো লক্ষণ।
কর দেয়া নাগরিক দায়িত্ব-এটা যেমন ঠিক। তেমনি যে নাগরিক কর দেয়, বিনিময়ে সে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কী পেলো, রাষ্ট্র তাকে কী সুবিধা দিলো, সেটিও বিবেচ্য। একজন নিয়মিত কর প্রদানকারী ব্যক্তি কি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে সেবা পাবেন? সরকারি অফিসে গিয়ে ঘুষ না দিয়ে কোনো কাজ করতে পারবেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশি হয়রানির হাত থেকে কি তার বেঁচে থাকা সম্ভব? তার বাসায় ইলেকট্রিক বা গ্যাসের অথবা পানির লাইনে সমস্যা হলে কি ঘুষ ছাড়া সেই সেবা নিশ্চিত হবে?এসব প্রশ্নের উত্তর যদি হয় ‘না’, তাহলে নাগরিকরা কেন কর দেবে?
যিনি আয়কর দেন, তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। ১৬ কোটি মানুষের দেশে যে লাখ বিশেক মানুষ কর দেন, তারা অবশ্যই বাকিদের চেয়ে আলাদা। তাদের দেশপ্রেম অবশ্যই ওইসব মানুষের চেয়ে বেশি, যারা করযোগ্য আয় করার পরেও আয়কর দেন না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পুরো দেশে এই যে ঝা চকচকে বহুতল ভবন, রাস্তায় কোটি টাকা দামের গাড়ির সারি, ঈদ-পার্বনের ছুটিতে বিদেশ গিয়ে আনন্দ উদযাপন, বাজারে ১০ হাজার টাকা দামের মাছও মুহূ্র্তে বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও করদাতার সংখ্যা মাত্র ২০ লাখ হয় কী করে?