চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

জঙ্গি হামলা ‘বাংলাস্তানের’ অঙ্কুরোদ্গম

২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষ বরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মাধ্যমে জঙ্গিবাদের সূচনা হয় বাংলাদেশে। তারপর আরও কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, সারাদেশ জুড়ে একসঙ্গে বোমা হামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বেশ কিছু জঙ্গি হামলা চালান হয়। ২০১৩ সাল থেকে শুরু হয় জঙ্গি হামলার নতুন পর্ব। তারপর থেকে একের পর এক জঙ্গি হামলা ঘটে চলছে। ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, পুরোহিত, সেবায়েত, বিদেশীদের মধ্যে থেকে একেক জনকে টার্গেট করে জঙ্গি হামলার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডগুলো সংগঠিত হচ্ছিল।

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি এবং শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজে যোগ দিতে যাওয়া মানুষের উপর হামলা ভিন্ন রকমের। তবে দুই রকমের হামালার দায় স্বীকার করেছে একই জঙ্গি সংগঠন, আইএস যারা আইসিস, আইসিল এবং দায়েস নামেও পরিচিত। সরকার বলছে দেশে আইএস নেই, তাদের ভাবধারার অনুসারী থাকতে পারে, এইসব হামলা করছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হিযবুত তাহরির, ইত্যাদি। এইসব সংগঠন কেন বড় বড় নাশকতা করছে এবং কেনই বা এদের ডাকে তরুণেরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষ হত্যার নেশায় মেতে উঠেছে – এমন প্রশ্ন আজ প্রতিটি বাঙালির মনে।

রাজনীতিবিদেরা, সমাজ পর্যবেক্ষকেরা এ বিষয়ে বিভিন্ন মতামত দিচ্ছেন। তাঁদের দেয়া মতামতগুলোর মধ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্যও রয়েছে। ১৭২ জন জঙ্গির জীবনী নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে লেখা “Understanding Terror Networks” বইয়ে ফরেনসিক মনোচিকিৎসক এবং প্রাক্তন কুটনীতিক, মার্ক সেজম্যান লিখেছেন, “দারিদ্র, আঘাত, পাগলামি, অবহেলা থেকে সৃষ্ট আবেগ কিংবা আচরণগত গোলযোগ নয়, বরং পরিবার এবং বন্ধুদের সামাজিক নেটওয়ার্কই তরুণ মুলসিমদের জঙ্গিবাদ এবং মানুষ হত্যা করার জন্য উৎসাহী করে”।

এ কথার পর স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে পরিবার বা বন্ধুরা কেন একজনকে জঙ্গি হতে উৎসাহী করবে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় অধ্যাপক জাফর ইকবালের “বিক্ষিপ্ত ভাবনা’ শীর্ষক সাম্প্রতিক নিবন্ধে। তিনি এই নিবন্ধে লিখেছেন, “বাচ্চাদের একটা স্কুলের শিক্ষকেরা আবিষ্কার করলেন, হঠাৎ করে একটা শিশু কেমন যেন মারমুখী হয়ে গেছে এবং স্কুলে এসে যখন-তখন অন্য বাচ্চাদের মারতে শুরু করছে। কিছুদিন পর আবিষ্কার হলো, সে সবাইকে মারছে না, ঘুরেফিরে সে নির্দিষ্ট কিছু শিশুকে মারছে এবং যাদের মারছে তারা সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। স্বাভাবিক কারণেই মারকুটে শিশুর সঙ্গে শিক্ষকেরা কথা বললেন এবং জানতে পারলেন, বাসা থেকে তাকে বলা হয়েছে, হিন্দুরা হচ্ছে কাফের এবং কাফেরদের মারতে হবে। তাদের মারলে সওয়াব হবে।”

অধ্যাপক ইকবাল উক্ত নিবন্ধে আরও লিখেছেন, “যে দুধের শিশুটি এ রকম একটা ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে, বড় হওয়ার পর তাকে নৃশংস একজন জঙ্গি বানানো নিশ্চয়ই পানির মতো সহজ।” ঐসব ধর্মান্ধ পরিবার বা বন্ধুরা জঙ্গি হওয়ার পরিবেশ তৈরি করছে। ধর্মান্ধ তারাই যারা নিজের ধর্ম ছাড়া অন্য সকল ধর্মকে হীণ জ্ঞান করে; নিজের ধর্ম ছাড়া সংস্কৃতির অন্যসব বিষয়কে অস্বীকার করে। ধর্মান্ধদের মধ্যে রয়েছে একদল উগ্রবাদী। যারা জোর করে নিজ বিশ্বাস অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায় তারাই উগ্রবাদী। উগ্রবাদীরাই কোমলমতি শিশুদের মধ্যে অপরিপক্ক তরুণদের মধ্যে হিংসার বীজ বপন করছে। আমাদের আসেপাশের লোকদের মধ্যে হর-হামেশা দেখছি ধর্মান্ধতার, উগ্রবাদীতার বীজ ছড়াতে।

অনেককেই কথায় কথায় সাবলীলভাবে বলতে দেখিঃ ‘মালাউন’; অন্যধর্মের বন্ধুদের আলাদা করে ফেলে সহসা; ধর্মনিরপেক্ষদের এরা যখন তখন ‘নাস্তিক’ বলে ফেলে কোন রকমের ইতস্ততা ছাড়া; এরাই হিন্দুরা দেশে আয় করে ভারতে অর্থ পাচার করে বলে মতামত দেয়। এরকম উদাহরণ অনেক অনেক। এর থেকে বেশি ধর্মান্ধ এবং উগ্রবাদী যারা তারা প্রকাশ্যে কিছু বলে না। পরিবারে এবং ঘনিষ্ট মহলে এরা জঙ্গিবাদী ভাবাদর্শ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। ধর্মান্ধদের ঘরে জন্ম নেয়া শিশুরা, তরুণেরাই জঙ্গি ভাবাদর্শের প্রশিক্ষকদের হাতে পরবর্তী সময়ে জঙ্গি হয়ে যায়।

এমন এক তরুণের মাত্র ১০ মাসে জঙ্গি হয়ে ওঠার গল্প পাওয়া গিয়েছে ২৪ জুলাই তারিখের দ্যা ডেইলি স্টারে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদ রাশেদ চৌধুরী টুটুলকে হত্যা প্রচেষ্টা মামলার অন্যতম আসামী, ১৯ বছর বয়স্ক সুমন হোসাইন পাটোয়ারী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে নিজের জঙ্গি হয়ে ওঠার কাহিনী বিবৃত করেন। চাঁদপুরের গ্রামের ছেলে বড় হয়ে ওঠেন চট্টগ্রামে; কাজ করতেন মেডিকেল যন্ত্রপাতির দোকানে। ধর্মভীরু সুমন নিয়মিত নামাজ পরতেন স্থানীয় মসজিদে। সেখান থেকে তাকে নির্বাচন করেন রিক্সার হুড সেলাই করার দর্জি কাওসার। কাওসারের সঙ্গে পরিচয়ের পর সুমন নিয়মিত কাওসারের দোকানে যেতেন ধর্মীয় আলোচনা করতে। সেখানে ধর্মীয় আলোচনায় পরিচয় হয় মাহবুবের সঙ্গে। এরপর কাওসার তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় মুদি দোকানী ইউসুফের সঙ্গে। কিছুদিন পর মাহবুব সুমনকে ফোন করে যহুরের নামাজের পর এক মসজিদে আসতে বলেন। সেখানে সে পরিচিত হয় মেহরাজের সঙ্গে। মেহরাজ তাকে protectedtext.com নামক ওয়েবসাইটে একাউণ্ট খুলে দেয়। সে একাউণ্টের মাধ্যমে সুমন মেহরাজের সঙ্গে জিহাদ বিষয়ে চ্যাটিং করত। কিছুদিন পর মাহবুব সুমনকে সেই একই মসজিদে মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মাহমুদ তাকে কিছুদিনের জন্য অন্যত্র যাবার প্রস্তাব দেয়। সে প্রস্তাবে রাজী হয়ে সুমন টঙ্গি চলে এসে নিজের মোবাইল ফোন এবং সিম কার্ড নষ্ট করে ফেলে হয়ে যায় জঙ্গি।

তাকে শুদ্ধস্বরের টুটুলকে হত্যা করার জন্য প্রথম এস্যাইনমেন্ট দেয়া হয়। কারা এই ধর্মান্ধ? এরা কি করে ধর্মান্ধতার চর্চা করে? ধর্মান্ধরা সমাজ বিচ্ছিন্ন কেউ নয়। এই সমাজেই তাদের বসবাস, চলাচল। এরা ধর্মের বিভিন্ন ধারা, উপধারার মতবাদে বিশ্বাসী এবং চর্চাকারী। ইসলাম ধর্মে রয়েছে ৪টি মাজহাব এবং শত শত মতবাদ। বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত এবং জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত তিনটি প্রধান মতবাদ হচ্ছে সালাফিজম, ওয়াহাবিজম এবং মওদুদীবাদ। একাদশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া আবু তায়মীয়াহ সালাফিজমের প্রচার করেন। তিনি ইসলাম ধর্মে ঢুকে পড়া বিভিন্ন ধর্ম এবং সংস্কৃতি থেকে ইসলামকে মুক্ত করে মহানবী এবং তার সাহাবী, সাহাবীদের সহচর এবং তাঁদের সহচরদের জীবনাচরণে যে ইসলাম বিধৃত হয়েছে শুধু তাই নিয়ে ধর্মচর্চার কথা বলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মুহাম্মাদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহাব সালাফি মতবাদ গ্রহণ করে তার সময়ে ইসলাম সংস্কারক হিসেবে কাজ করেন। তিনি মাজার পন্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

তিনি আরবের বহু মাজার ধ্বংস করে দেন। এসব মাজারের মধ্যে এমনকি মহানবীর সাহাবীদের মাজারও রয়েছে। আল-ওয়াহাবকে সৌদি বাদশাহ মুহাম্মাদ বিন সৌদ ১৭৪৪ সালে তাঁর রাজত্বে ধর্ম প্রচারণার কাজে নিযুক্ত করেন। এ সম্পর্কে ১৯৬২ সালে জন্ম নেয়া সৌদি অধ্যাপক Madawi al-Rasheed তার A History of Saudi Arabia বইতে লিখেছেন যে আল-ওয়াহাব বাদশা সৌদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, “You are the settlement’s chief and wise man. I want you to grant me an oath that you will perform jihad against the unbelievers. In return you will be imam, leader of the Muslim community and I will be leader in religious matters.” আধুনিক ইসলামে জঙ্গিবাদের অনুপ্রবেশ এখান থেকেই। অমুসলিমদের এবং অনৈসলামিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সন্ত্রাসের আদর্শিক ভিত্তি সৃষ্টিকারী আল-ওয়াহাবের অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বিংশ শতাব্দীর আবু আলা মউদুদী।

জামায়াতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মউদুদীকে আধুনিক ইসলামীক স্টেটের স্বপ্ন দ্রষ্টা হিসেবে গণ্য করা হয়। সালাফিজমের আলোকে শরীয়া আইনের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইসলামের জন্য রাজনীতিকে অপরিহার্য বলে বিবেচনা করতেন। তিনি ইসলামকে রাজনীতি করনের মাধ্যমে পাকিস্তানে ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক মুহাম্মদ জিয়াউল হকের উপর তিনি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন।

ধারণা করা হয় যে জিয়া উল হকের সময় জামায়াতের ১০,০০০ কর্মী এবং সমর্থককে বিচার বিভাগ এবং জনপ্রশাসনে নিয়োগ করা হয়। এই নিয়োগ জামায়াতকে শক্তিশালী ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করে। বিশ্বজুড়ে উগ্র মুসলিমদের উপর মওদুদীর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আল-কায়েদা, আইএস, বোকো হারাম, ইত্যাদি জঙ্গি সংগঠন সমূহ মওদুদীর ইসলামিক স্টেট ধারণা গ্রহণ করেছে। ইসলাম ধর্মের প্রতি অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ১৯৭৯ সালে “সৌদি এরাবিয়ান কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড” দেয়া হয়। তিনিই এই পদকের সর্বপ্রথম গ্রহীতা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)