চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

জঙ্গিদের খুন খারাবি এখন অনুমোদিত কিংবা বিচারের উর্ধ্বে

রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন যখন বললেন, ‘সারা দেশে ব্লগার হত্যার আঘাতের ধরনের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী (৫৮) হত্যার মিল রয়েছে, পুলিশের ধারণা, ইসলামি চরমপন্থীদের হাতে তিনি খুন হয়েছেন,’ তখনই মনে হয়েছে-  ব্যাস! হয়েছে তো।  বাংলাদেশে  আনসার আল বাংলা টিম বা ইসলামী জঙ্গীদের এই দেশে খুনখারাবী করার লাইসেন্স আছে। রেজাউল করীমের খুনীরা যদি জঙ্গী হয়- তা হলে এর তদন্তকাজ এখানেই শেষ।

হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত  অধ্যাপক সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পুলিশের গ্রহণযোগ্য কোনো অগ্রগতি আছে- এমন সংবাদ পাওয়া যায়নি। বরং এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যাপারে সংশয় তৈরি হওয়ার মতো ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। বরাবরের মতো আই এস স্বেচ্ছায় এই হত্যাকাণ্ডের দায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। আইএস বা আনসার আল বাংলা টিম বা ইসলামি কোনো জঙ্গী কোনো হত্যাকাণ্ডের দায় দায়িত্ব স্বীকার করলেই বাংলাদেশের পুলিশ যেনো দায়মুক্তি পেয়ে যায়। তারা মনে করে- এইবার তাদের কাজ শেষ- এই খুন নিয়ে আর না ভাবলেও চলে। বাকি কাজটা আসলে রাজনীতিকদের তথা সরকারের।

রাজনীতিক বা সরকারও কিন্তু খুনীদের হত্যার বা বিচারের দায়িত্ব নেয় না। তাদের কাজ হয়ে দাঁড়ায় খুন হওয়া লোকটা কোনোকালে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো কথা লিখেছে কী না। ব্যাস, এইটুকু প্রমাণ করা গেলেই যে কোনো খুনের বিচারের দায় দায়িত্ব শেষ। গত কয়েক বছর ধরেই তো এই প্রক্রিয়া চলছে। অধ্যাপক সিদ্দিকীর বেলায় তার  ব্যতিক্রম হবে কেন?

অধ্যাপক সিদ্দিকীর যেহেতু ব্লগার হিসেবে ‘স্বীকৃতি’ নেই, অতীতে আন্দোলনে সম্পৃক্ততারও কোনো তথ্য প্রকাশ্য নয়; ফলে তিনি খুন হওয়ার পর সম্ভবত পুলিশ একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো। এমন নিভৃতচারী একজন শিক্ষকের খুন হওয়াটাকে ‘সাফাই’ গাওয়ার যুক্তি নিয়ে সম্ভবত তারা খানিকটা চিন্তিত ছিলো। যে কারণে রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার দ্রুত জানিয়ে দিয়েছেন- এটি ইসলামী জঙ্গিদের কাজ বলে পুলিশ মনে করছে। কারণ ইসলামী জঙ্গিদের খুন খারাবি সম্ভবত এই দেশে ‘অনুমোদিত’ কিংবা বিচারের উর্ধ্বে।

অধ্যাপক সিদ্দিকী হত্যার পর পুলিশ বা গোয়েন্দারা কি করছেন- তা আমাদের জানা নেই। তারা কি খুনীদের খুঁজছেন- না কি  অধ্যাপক সিদ্দিকীকে নাস্তিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার তথ্য উপাত্ত খুঁজছেন তা আমরা জানি না। আমাদের করিৎকর্মা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ‘খুনী জঙ্গিই হোক আর যেই হোক, ধরে ফেলবো।’

এই তো গেলো সরকারের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার ব্যাপারে বিএনপির প্রতিক্রিয়া কী? শনিবার সকালে খুন হয়েছেন অধ্যাপক সিদ্দিকী, শনিবারই সংবাদ সম্মেলন করেছেন বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাদের সংবাদ সম্মেলনের বিষয় অবশ্যই নির্ধারিত ছিলো- জয়ের অপহরণ অভিযোগ ও শফিক রেহমানের গ্রেফতার। তাই বলে একটি নিমর্ম হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলা যাবে না- তার তো কোনো দিব্যি নেই।

বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল, অতীতে ক্ষমতায় ছিলো, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে চায়। দেশের চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে পাবলিক ডিমান্ডিং ইস্যুগুলো সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান অবশ্যই পরিস্কার থাকা দরকার। ব্লগার, লেখক- কারো হত্যাকাণ্ডেই দল হিসেবে বিএনপি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হত্যায় যে রাজনৈতিক দলটি মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না- সেই রাজনৈতিক দলটি জনগণের সমর্থন চাওয়ার অধিকার রাখে কী না সেটিও ভাবা দরকার।

একের পর এক খুন হচ্ছে অথচ সরকার সেগুলোর বিচার করতে অনাগ্রহী। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসতে আগ্রহী রাজনৈতিক দলটিও এ নিয়ে কোনো কথা বলতে আগ্রহী নয়। খুনীদের প্রতি সহানুভূতির এমন সমন্বয় আর কখনোই কি ঘটেছে- এই দেশে!

না ঘটেনি। যেমন ঘটেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খুন হয়ে যাওয়ার পরও শিক্ষকদের নিরব থাকার ঘটনা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কী যেন একটা কর্মসূচী নিয়েছেন বলে শুনেছি। মিডিয়ায় তার তীব্রতা টের পাওয়া যায়নি এখনো। আর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সম্ভবত নিজেদের  শিক্ষক নন- ভেবে তৃপ্তিতে আছেন। আচ্ছা, শিক্ষক খুন হলে এখন আর ছাত্রদের মধ্যেও কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না কেন? না- মানে, ছাত্র সংগঠনগুলোর কথা বলছি। স্রেফ একটি খুনের বিরুদ্ধে, নিভৃতচারী একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের খুনের প্রতিবাদেও যে ছাত্রসংগঠনহুলো রাস্তা কাঁপাতে পারে না, ক্যাম্পাস কাঁপাতে পারে না- তারা কিসের ছাত্র সংগঠন! এই সংগঠন আর নেতাদের জন্য ‘ছি!’ বলা ছাড়া আর কিইবা থাকে আমাদের।

একের পর এক ব্লগার হত্যার পর সেগুলোর বিচার না করা, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী নেতাদের বক্তৃতা বিবৃতিতে এক ধরনের ‘বিচারহীনতা’র পক্ষে সমর্থনের’ বহি:প্রকাশ একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ‘এমন হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্র বিচার করবে না’- এরকম একটি বিশ্বাস এখন জনমনেও ভিত্তি পেয়ে গেছে।

কিন্তু সাধারণ মানুষও কি এই সব খুন খারাবিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে? নাকি আতংক তাদের বোধকেও গ্রাস করে রেখেছে!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের
নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে
প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)