বাঙালি জাতির ইতিহাসে ৭ জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটি আমরা দীর্ঘদিন যাবত ছয় দফা দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছি। এ বছর বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর আক্রমণ ভয়াবহ মহামারি রূপে আঘাত করেছে। যার জন্য আমরা বঙ্গবন্ধুর শতবার্ষিকী মুজিববর্ষে এ দিনটি আমাদের আকাঙ্খা অনুযায়ী সাড়ম্বরে উদযাপন করতে পারছি না। এই দিনটিতে আনুষ্ঠনিকভাবে নতুন করে লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মীরা শপথ নিতে পারতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের। করোনাভাইরাসের কারণে তা সম্ভব না হলেও আমরা বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা নিশ্চয় এই দিনে সেই শপথ বানী উচ্চারণ করবো- প্রাণের গভীর থেকে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন তথা জনগণের কল্যাণ সাধনই হবে এই শপথের মূল লক্ষ্য।
আমরা জানি ৭ জুনের ব্যাপ্তি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত এবং এর সাথে পূর্বাপর এত ঘটনাপঞ্জি জড়িত যে একটি ছোট নিবন্ধের পরিসরে তা তুলে ধরা কঠিন। আমি মনে করি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এক মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের রূপকার ও মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মহাকাব্যে রয়েছে বিভিন্ন ঘটনা বহুল অধ্যায়। যার মধ্যে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের ২১ দফার ভিত্তিতে স্বায়িত্বশাসনসহ বিভিন্ন বৈষম্য দূরের দাবিতে সাধারণ নির্বাচন, ৬২’র সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আন্দোলন, শিক্ষা, অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা এবং ঊনসত্তরে আওয়ামীলীগের ছয়দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা ভিত্তিক গণঅভ্যুত্থান, সর্বপরি ৭১ সালের নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পদ্মা- মেঘনা-যমুনা পাড়ের এই জনপদ নিয়ে পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সব অধ্যায়রই অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঊনিশশো বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে নবরূপে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয়েছিল, আমরা বপন করেছিলাম জাতি রাষ্ট্র গঠনের বীজ। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। আমরা যদি ইতিহাসের পিছনের দিকে যাই ১৯৪৭ সালে অবৈজ্ঞানিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দুই হাজার কিলোমিটার ব্যবধানে দুটি ভূখন্ড নিয়ে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দুই ভূখন্ডের মানুষের ভাষা ছিল আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা, আচার আচরণ, জীবন প্রবাহ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ধর্মের বন্ধন ছাড়া দুই ভূখন্ডের মধ্যে কোন দৃঢ়মূল বন্ধন ছিল না। এই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই সামন্ত ভূস্বামীরা, ভারত থেকে প্রত্যাগত অভিজাত উর্দূভাষীরা, শিল্পপতি, ধনিক-বণিক শ্রেণি, সামরিক বেসামরিক আমলারা সুপরিকল্পিতভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। তারা প্রথমে আঘাত হানে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের মেধা-মনন ও উচ্চ চেতনা যাতে বিকশিত না হতে পারে, বাংলার মানুষকে একটা পঙ্গু জাতিতে রূপান্তর করে চিরদিনের জন্য তাদের শোষণ নির্যাতন করা যায়।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী তখন প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় ও সৈয়দ মুজতবা আলী ভারত থেকে সাহিত্য সম্মেলনে এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তাঁরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন- “বঙ্গবন্ধু আপনি কখন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন, স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেন?” উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “৪৭ এর আগেই কলকাতার পাক সার্কাসে আমরা একটা সভা করেছিলাম, সেই সভায় আমরা অনেক তরুণেরা ছিলাম, সেদিনই আমরা বুঝেছিলাম যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হচ্ছে না। স্টেটস এর “এস” শব্দটাকে দিল্লির মুসলিমলীগ সম্মেলনে কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। এ থেকে আমরা বুঝে ফেলি কায়েদা আজম ও তার সহযোগিরা ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। যেভাবে লাহোর প্রস্তাবে সার্বভৌমত্ব ও স্বায়ত্তশাসনসহ আলাদা একটা স্টেট ইউনিট গঠনের কথা ছিল সেটা আর থাকছে না। সেদিনই আমি বুঝে ছিলাম যে পাকিস্তান হয়েছে- এই পাকিস্তানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থাকবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দীর্ঘ দিন দেখেছেন পাকিস্তান কিভাবে পূর্ববাংলাকে শোষণ করছে, শাসন নির্যাতন করছে। আপন অভিজ্ঞতা ও বেদনা থেকে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের চিত্র সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান দিয়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি জাতির সামনে শোষণ ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে বেসরকারি চাকরিতে, সরকারি চাকরিতে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব ছিল খুবই কম। আর্থ সামাজিক উন্নয়নে, শিল্পকারখানা স্থাপনে, বিভিন্ন জায়গায় পূর্ববাংলা ছিল বঞ্চিত। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান শতকরা ৬০-৭০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতো, যার মাত্র ২৫ ভাগ খরচ হতো পূর্ববাংলায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে মাত্র ৬ ভাগ, নৌবাহিনীতে মাত্র ৮ ভাগ এবং বিমানবাহিনীতে মাত্র ১৬ ভাগ ছিল বাঙালি। উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা ১০-১২ জনের বেশি ছিল না। আর পাকিস্তানের ১২৩ জন জয়েন্ট সেক্রেটারীর মধ্যে মাত্র ০৮ জন ছিল বাঙালি, কোন সচিব ছিল না। উন্নয়ন খাতে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৫-৬৬ সাল পর্যন্ত যেখানে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে সেখানে পূর্ববাংলার জন্য খরচ করা হয়েছিল মাত্র ৯০০ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতায় উঠে আশা এসব পরিসংখ্যান ছিল আমাদের জন্য, বাঙালিদের জন্য তীব্র বঞ্চনার ও ক্ষোভের। বঙ্গবন্ধু সেটা উপলদ্ধি করেছিলেন। তাই তো তার চেতনায় মূর্ত হয়েছিল বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার চিন্তা। তাইতো তিনি শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে ৬৪ সালে এনডিএফ থেকে বের করে আওয়ামী লীগকে পুনঃজ্জীবিত করেন। তিনি ৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের সময় বিশেষভাবে উপলদ্ধি করেন পূর্ববাংলার নিরাপত্তাহীনতা বিষয়টি। ঐ যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করার কোন ব্যবস্থা বা সুরক্ষা পরিকল্পনা পাকিস্তানীদের ছিল না। এ বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা প্রণয়ন করেন। ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে বিরোধী দলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি সম্মেলন হয়, তিনি সেখানে ছয় দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে তাকে এ প্রস্তাবনা তুলতে দেয়া হয়নি। তবু বঙ্গবন্ধু থামার পাত্র নন, তিনি দেশে ফিরে এসে ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে ছয় দফা তুলে ধরেন। যে ছয় দফার মূল দাবি ছিল বাংলাদেশের স্বায়ত্বশাসন। তিনি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শুধু পররাষ্ট্র ও দেশ রক্ষা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে আর বাকি সবকিছু যেমন-মুদ্রা ব্যবস্থা, কর ধার্যকরণ, প্যারামিলিশিয়া, বৈদেশিক বানিজ্য এবং বানিজ্য প্রাদেশিক সরকার তথা পূর্ব পাকিস্তানের হাতে ন্যস্ত করার দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তিনি ছয় দফা দাবীকে বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ হিসাবে ঘোষণা করেন।
কিন্তু এই পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি, শোষক গোষ্ঠি, যারা বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করতে চেয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই তারা ছয় দফা মেনে নিতে পারেনি। এই ছয় দফা ঘোষণার পর পরই ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে বঙ্গবন্ধু এটিকে অনুমোদন করিয়ে নেন। মার্চ মাসের ১৮, ১৯, ২০ তারিখ আওয়ামীলীগের কনফারেন্স হয়। সেই কনফারেন্সে আওয়ামীলীগের সারা দেশের প্রতিনিধিরা ছয় দফাকে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসাবে গ্রহণ করেন। ২৮ শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু ছয় দফার পক্ষে একটি জনসভা করেছিলেন। সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “এই চট্টলার বীর জনতা জালালাবাদ পাহাড়ের উপরে বৃটিশ সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুক্তির পতাকা তুলেছিল। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, চট্টগ্রামের মানুষ আবার এই বাঙ্গালীর বাঁচার দাবী ছয় দফার পতাকাও জালালাবাদ পাহাড়ে তুলবে”। তারপর থেকে তিনি এক টানা ছয় দফার পক্ষে প্রচার শুরু করেন। খুবই সহজ সরল ভাষায় নিজে তিনি একটা পুস্তিকা রচনা করেন। সেই পুস্তিকা তিনি সারা বাংলাদেশে প্রচার করেন এবং মার্চের পর থেকে তিনি একটানা ৩৫ দিনে ৩২ টি জনসভা করেন। এ সময়ে ছয় দফা ঘোষণা দেয়ার পর থেকে আট বার তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর ছেড়ে দেওয়া এবং আবার গ্রেফতার করা চলতে থাকে। ১৯৬৬ সালের ৮ মে’র পর থেকে ৬৯ এর ২২ শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন বৎসর বঙ্গবন্ধু একটানা জেলখানায় ছিলেন, আর বের হতে পারেনি। এ সময় তাকে এক নম্বর আসামি করে “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং” শিরোনামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। এ মামলাকে প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্রদ্রৌহ মামলা নামে অবিহিত করা হয়- যার দূরভিসন্ধি ছিল বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা। ১৯৬৬ সালের মে মাসের ২০ তারিখে আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটি হয়, সেই ওয়ার্কিং কমিটিতে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য এবং ছয়দফা দাবীর পক্ষে ৭ জুন হরতাল ডাকা হয়। সেই হরতালের জন্য সারাদেশের ছাত্র সমাজ, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালায়, শ্রমিকরাও ব্যাপক ভাবে প্রচার চালায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ১ লা মে’ তেও নারায়নগঞ্জে শ্রমিকদের একটি সভা করেছিলেন। এ বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তুলে ধরেছিলেন পশ্চিম ও পূর্বপাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যর নিদারুণ চিত্র। পাকিস্তানের এই বৈষম্য নীতি, বাঙালির শোষণ বঞ্চনা এ দেশ থেকে সম্পদ পাচার এবং রাষ্ট্রিয় সম্পদ লুটপাটের চিত্র তিনি শ্রমিক সমাবেশে তুলে ধরেন।এ জনসভায় শ্রমিক সমাজ ছয় দফার প্রতি দ্বার্থহীন সমর্থন ঘোষণা করে।
আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুসারে ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তানী সরকার, স্বৈরাচার আইয়ুব খাঁনের গোলাম বলে পরিচিত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর কুখ্যাত মোনায়েম খান এ হরতাল রুখতে ইপিআর এবং পুলিশ নামিয়ে দেন। শত চেষ্টা করেও সেই হরতাল দমন করা সম্ভব হয়নি। সারা পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী বিভিন্ন সমাবেশে এবং মিছিলের উপর পুলিশ, ইপিআর গুলি চালায়। ৭ জুন ১৯৬৬, এই দিনে মুনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি।
এই ৭ জুন হয়ে ওঠে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের এক উজ্জল টার্নিং পয়েন্ট। ছয় দফার এ আন্দলনে বাঙ্গালীর স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার চেতনা আরো সুদৃঢ় হয়। সূর্যের আলোর মত বাঙ্গালী জাতির হৃদয়ে প্রজ্জলিত হয়ে ওঠে-শোষণ- নির্যাতন মুক্তির তীব্র আকাঙ্খা তথা স্বাধীনতা অর্জনের অভিমূখে যাত্রার প্রেরণা। বঙ্গবন্ধু জেলের ভীতরে থেকেও মানুষকে এমনভাবে সংগঠিত করেন, যোগাযোগ রাখেন যে- ছয় দফার আন্দোলন, ৭ জুনের ত্যাগ ও সাহসিকতা, মানুষের অংশগ্রহণ, সারাদেশে বিদ্রোহের অগ্নীস্ফুলিংগের সৃষ্টি করে।
১৫ জুন, ইত্তেফাক পত্রিকায় (৭ জুনের খবর পত্র পত্রিকায় ছাপানো নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও) এই বার্তা প্রকাশ করা হয় যে, বাংলার জনগন যেভাবে ৭ জুন পালন করেছে, হরতাল করেছে তাতে বুঝা যায়- শেখ মুজিবের ছয়দফা কে মানুষ গ্রহণ করেছে। এই সংবাদ পরিবেশনের জন্য ইত্তেফাক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। নিউনেশন প্রেসকে বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর ফলে ছয় দফা সারা দেশে ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা লাভ করে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের গানের অমোঘ বাণী “ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে/ ওদের আঁখি যতই রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে” সংগ্রামী বাঙ্গালির জীবনে সত্য হয়ে ওঠে।
এই অবকাশে আমি ইতিহাসের একটি প্রামান্য তথ্য তুলে ধরতে চাই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্বপাকিস্থারের ৯৭ ভাগ মানুষ যুক্তফ্রন্টের পক্ষে, বাংলাদেশের স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এ রায় ছিল মূলত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে বাঙ্গালির সুস্পষ্ট সূদৃঢ় অবস্থান। কিন্তু সেই নির্বাচিত সরকারকে দেশ চালাতে দেয়া হয়নি। ৯২ (ক) ধারা জারি করে সরকারকে বাতিল করে দেয়া হয়। সেই ৯২ (ক) ধারার সময় পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর ছিলেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। তিনি একটা গোপন রিপোর্ট পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে পাঠান। সেখানে তিনি লিখছেন Ò(Shekh Mujibur Rahman has been in prison in Several TimesÓ”(অনেক সময় শেখ মুজিব জেলে ছিলেন)। ÒHe is remarkably a good Organige (তিনি একজন অসাধারণ সংগঠক). ÒHas gutsÓ (তার রয়েছে শক্তিশালী মেরুদন্ড)
Holds extreme views in politics (সে কোন দিন তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি, লক্ষ্যের বিষয়ে তিনি আপোষহীন। ÒHe is an experienced agitatorÓ (যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি মানুষকে উত্তেজিত করতে পারেন। তিনি সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী। ÒMan described as a stormy Petrels of Awami leagueÓ (প্রেট্রেল হলো সমূদ্রের এমন একটা পাখি যে অনেক দূর উড়ে যেতে পারে শক্ত তার পাখা। অর্থাৎ আওয়ামীলীগের প্রেট্রেল বঙ্গবন্ধু যে কোন ঝড়, ঝঞ্জা বাধা বিপত্তির মুখে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি রাখে।)ÒA Dangerous Gentlemen who is Best in JailÓ (পাকিস্তানের জন্য অতিশয় বিপদজনক এ ভদ্রলোককে জেলে রাখায় উত্তম)
আইয়ুব খান যখন দেখলেন, শেখ মুজিবকে জেলে রেখেও তার আন্দোলনকে দমন করা যাচ্ছে না, তখন তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ফাঁদা হলো। পাকিস্তানী স্বৈরশাসকেরা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁরা সফল হয়নি। ১৯৬৯ এর অভুতপূর্ব গণঅভ্যূত্থানে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতন হয়। বঙ্গবন্ধু মহাবীরের বেশে জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর জনগণের মধ্যে ফিরে আসেন। ছাত্র জনতা আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় বাঙ্গালীর নয়নের মনি, মুক্তি দূত জননেতা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ছাত্র নেতা জনাব তোফায়েল আহমেদ এই ঘোষণা বাণী উচ্চারণ করলে লক্ষ-ছাত্র জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। এই ঘটনার পর বাংলার মানুষ আরো ঐক্যবদ্ধ হয়, ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়।
এসব ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহে নানা বিবেচনায় আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে এই ছয় দফা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ছয় দফার ধারাবাহিকতায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়েছিলাম এবং একাত্তর সালে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
তাই আমরা বাংলার সাত কোটি মানুষ তাঁর ডাকে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলাম।
বঙ্গবন্ধু সবসময় স্বপ্ন দেখেছেন- ক্ষধা মুক্ত, দারিদ্র মুক্ত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তাঁর এই স্বপ্নকে সাদামাটা ভাষায় বলতেন “ আমি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই”। প্রাকৃতিক বৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ। নদী নালা খালবিল, অবারিত মাঠ , ধান ক্ষেত, পাল তোলা নৌকার স্বপ্নযাত্রা এসবে মুগ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশপ্রেমকে উজ্জিবিত করেছিলেন। তিনি মধুমতির তীরে জন্মগ্রহণ করে, বিচরণ করে প্রাণ ভরে প্রতিনিয়ত বাংলার অপরুপ সৌন্দর্য্য দেখেছেন। দেখেছেন-শোষিত-বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপিড়িত মানুষের নিষ্ঠুর দারিদ্রপীড়িত কষ্টের জীবন। তাই তিনি সবসময় বাঙ্গালির মুক্তির কথা চিন্তা করেছেন। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হন গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। তিনি তাঁর স্বপ্ন- ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে যেতে পারেননি। ছয় দফা দাবীর যে অর্ন্তনিহিত প্রত্যাশা ছিল স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র গঠন এবং বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা আমাদের বিশ্ব নন্দিত প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। যে দেশে পাকিস্তান আমলে মাত্র সাত কোটি মানুষের জীবন ছিল নিদারুন দারিদ্র পীড়িত- সেই দেশের সতের কোটি মানুষ আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দারিদ্র জয়ের লড়াই এ দারুনভাবে অগ্রসরমান।
আমাদের প্রতিটি দিনই বিজয়ের দিন। বিশ্ব কাঁপানো করোনা মহামারি জয়ের স্বপ্ন দেখছি আমরা। সকলে মিলে এ স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করবো, মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশত বর্ষ পালনের প্রাক্কালে এবং মুজিব বর্ষে এই হোক ছয় দফা দিবসের প্রতিজ্ঞা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)