চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ছাত্রলীগের ‘সিন্ডিকেট’ আসলেই কি ভাঙছে?

ছাত্রলীগের কথিত সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য যে প্রচেষ্টা দলের হাইকমান্ড থেকে চালানো হচ্ছে সে প্রক্রিয়া আসলেই কতটা সফল হবে, সম্মেলনের আগে এমন প্রশ্ন আসছে ঘুরে ফিরে। সিন্ডিকেট ভাঙতে পাল্টা সিন্ডিকেট গড়ে উঠবে কিনা বা নতুন নেতৃত্বকে আদৌ সিন্ডিকেটের প্রভাবমুক্ত রাখা যাবে কিনা আসছে সে প্রশ্নও।

আগামী ১১-১২ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কেন্দ্রীয় এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের বিভিন্ন পর্যায়ের দুই শতাধিক নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে।

অভিযোগ আছে, গত কয়েকটি সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা নির্বাচিত হলেও সে ভোট ছিলো লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মূলত সিন্ডিকেট যাদের মনোনীত করেছে, তারাই নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। প্রার্থীর দৌড়ে থাকা বাকিরা অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন অথবা নিশ্চুপ থেকেছেন।

ভোটে দিলে শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের কোনো প্রার্থীই বেরিয়ে আসবে এমন আশঙ্কা থেকেই আসন্ন সম্মেলনে যে ভোট হচ্ছে না, সে ব্যাপারে আগেই আভাষ পাওয়া গিয়েছিলো। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে দেওয়া বক্তব্যে সে ব্যাপারটি মোটামুটি নিশ্চিত এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ছাত্রলীগের সিন্ডিকেট কী?
ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন, গত তিনটি সম্মেলনে ছাত্রলীগের যে শীর্ষ নেতৃত্ব উঠে এসেছে তারা সিন্ডিকেটের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই এসেছেন।

তারা জানান, কথিত এই সিন্ডিকেটের মূল নেতৃত্বে আছেন ছাত্রলীগের সাবেক একজন সভাপতি। যিনি নির্বাচিত হন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট আমলে। তার সঙ্গে রয়েছেন কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাধিক সাবেক নেতা যারা বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদেও রয়েছেন।

গত তিনটি সম্মেলনে (২০০৬, ২০১১ এবং ২০১৫) এই সিন্ডিকেট যাদেরকে মনোনয়ন দিয়েছেন তারাই নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ দুটিতে।

যেভাবে প্রভাব রাখে সিন্ডিকেট
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ২৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি হলেও সংগঠনটির ক্ষমতা মূলত কেন্দ্রীভূত থাকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের হাতে। এই দুই নেতার সাক্ষরেই পরবর্তীতে সংগঠনের পুর্ণাঙ্গ কমিটি ছাড়াও প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন হয়। সাংগঠনিক জেলাগুলোতে কারা নেতৃত্বে আসবেন সে ব্যাপারেও থাকে সিন্ডিকেটের নির্দেশনা।

সূ্ত্র জানায়, ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা থেকে ভোটার থাকেন ২৫ জন করে। এই ২৫ জন ভোটার কীভাবে বাছাই করা হবে তার কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। তাই সাংগঠনিক জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকই তাদের পছন্দের লোকদের ভোটার হিসেবে বাছাই করেন। অনেক ক্ষেত্রে শুধু সভাপতি সাধারণ সম্পাদক এসে বাকী ২৫ জনের ভোট দেন এমন নজিরও রয়েছে।

ছাত্রলীগের একাধিক বর্তমান ও সাবেক নেতা চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, ব্যাপারটা এমন যে, সিন্ডিকেটের পছন্দে শীর্ষ দুই নেতা, এই দুই নেতার পছন্দে এবং সিন্ডিকেটের নির্দেশনায় সাংগঠনিক জেলার শীর্ষ নেতা এবং সাংগঠনিক জেলার শীর্ষ নেতাদের পছন্দে ভোটাররা। সুতরাং সিন্ডিকেট যাদের মনোনীত করে শীর্ষ দুই নেতাও সাংগঠনিক জেলার নেতাদের কাছে তাদের ব্যাপারে গ্রিন সিগনাল দেন এবং সাংগঠনিক জেলার নেতারাও ভোটারদের তাদের কথা বলে দেন। এভাবেই লোক দেখানো ভোটে নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।

গড়ে উঠেছে পাল্টা সিন্ডিকেট
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র জানায়, কথিত সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য একমত থাকলেও নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের নেতৃত্বে আনতে সিন্ডিকেট-বিরোধীদের মধ্যেই আবার অন্তত দুটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের একটির নেতৃত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা। তার সঙ্গে রয়েছেন দলের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক যিনি ছাত্রলীগেরও সাবেক সভাপতি। অপরটিতে রয়েছেন আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম-সম্পাদক। তার সঙ্গে রয়েছেন একজন সম্পাদক, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।

সিন্ডিকেট ভাঙতেই সিলেকশন
সিন্ডিকেটের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যারা নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্বল নেতৃত্ব ছাড়াও দলীয় স্বার্থের চেয়ে সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা এবং ভিন্ন আদর্শের নেতাদেরও সংগঠনে পুনর্বাসনের অভিযোগ রয়েছে।

গত মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যেই কথা বলেন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘‘কারও পকেটের কমিটি দিয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব হবে না। কোন সিন্ডিকেট দ্বারা ছাত্রলীগ চলবে না। ছাত্রলীগ চলবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শেখ হাসিনার নির্দেশনায়। এর বাইরে কোন ভাবনা চিন্তা করার অবকাশ নেই।”

ভোটের মাধ্যমে শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করলে সিন্ডিকেটের বাইরে থেকে কোন প্রার্থীর নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। এ জন্য কথিত সিন্ডিকেটের প্রভাবমুক্ত রাখতে সিন্ডিকেট-বিরোধীরা শুরু থেকেই বলে আসছিলেন এবার নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে সিলেকশনের মাধ্যমে।

এরপর গত ২ তারিখে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন: ভোটের আগে সাধারণত সমঝোতা হয়। সে রকমই চেষ্টা করা হবে। যদি সমঝোতা ব্যর্থ হয়, তাহলে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। তবে, ভোটে উল্টাপাল্টা কেউ আসলে তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। ছাত্রলীগের প্রার্থীদের তালিকা তার কাছে রয়েছে বলেও জানান তিনি।

সূত্র জানায়, এর আগে একাধিক অভ্যন্তরীণ বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ধারণ করে, মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয়, মেধাবী ছাত্র পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ঐতিহ্য রয়েছে এমন নেতাদের মধ্য থেকে এবার শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। এজন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং দলীয় নেতাদের মাধ্যমে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানায় একাধিক সূত্র।

সিন্ডিকেটের বাইরে নতুন নেতা নির্বাচন সম্ভব?
প্রধানমন্ত্রী এবং ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব গোয়েন্দা  সংস্থা এবং বিশ্বস্ত নেতাদের মাধ্যমে বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়ে নেতা নির্বাচন করবেন এমনটাই জানিয়েছে একাধিক সূত্র। তারপরেও নতুন নেতৃত্ব সিন্ডিকেটের বাইরে থেকে কেউ নেতৃত্বে আসতে পারবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

কারণ একাধিক সূত্রের দাবি, নেতৃত্বের দৌড়ে যারা এগিয়ে আছেন এবং আলোচনায় আছেন বা মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত। কারণ সিন্ডিকেটের সবুজ সংকেতে যারা যারা পদ পেয়েছেন তারাই মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং নেতৃত্বের দৌড়ে এগিয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী খোঁজ-খবর নিলেও এদের ব্যাপারেই নিবেনে। মাঠের রাজনীতিকে সক্রিয় ছিলেন না এমন অপরিচিত কাউকে শীর্ষে নিয়ে আসার সম্ভাবনাও নেই। তাই একেবারেই সিন্ডিকেটের বাইরে কাউকে নির্বাচন করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সে ব্যাপারে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।