মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা। কী কারণে, কেন মরছে মানুষ? এমন প্রশ্ন শত শত মানবতাবাদীর। রাখাইনে পুড়ছে বাপ-দাদার বসতভিটা। দেশান্তরী রোহিঙ্গারা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকছেন বাংলাদেশে। ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেনজুড়ে মানবতার আর্তনাদ। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের পতনের পর নতুন নামে জঙ্গিবাদ জেঁকে বসেছে, আফগানিস্তানে। ইসরায়েল-আমেরিকা তন্ত্রে নির্বাক ফিলিস্তিনিরা। গাজায় টানা ৬ সপ্তাহে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধশত মানুষ। হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন আরও ৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি।
এমন বাস্তবতায়, মানুষের মুক্তির ঠিকানা কী? কিংবা ধনাঢ্য শ্রেণির বাইরে কেবলই কী শোষিতরা আরও নিপীড়িত হতে থাকবেন? এমন যখন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে চারদিকে, সেসময়টায় দাড়িয়ে আজ বিশ্বজুড়ে স্মরণ করা হচ্ছে বিপ্লবী কার্ল মার্ক্সকে।
আমরাও গণমাধ্যমকর্মী, মার্ক্সও ছিলেন সংবাদপত্রেরই মানুষ। কার্ল মার্ক্স নিয়মিত লিখতেন, প্রকাশ করতেন পত্রিকা। আমাদের সাথে পার্থক্য শুধু প্রযুক্তির। আজ হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ার জয় জয়কার। চাইলেই এক ক্লিকে বিশ্বের সব তথ্য খুঁজে নেয়া যায়। হাতের কাছেই কার্ল মার্ক্সের বই। কিন্তু প্রশ্নটা অন্যখানে। কার্ল মার্ক্স বেঁচে থাকলে এই বিশ্ব ব্যবস্থায় কী করতেন? পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে কোরিয়া কিংবা ইরানের সঙ্গে মার্কিন দ্বন্দ্ব। অথবা ইরাকে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের অজুহাতে সাদ্দামকে উচ্ছেদ কিংবা বিষাক্ত রাসায়নিক হামলার মিথ্যে অজুহাতে সিরিয়া থেকে বাশার আল আসাদকে উচ্ছেদের চেষ্টা। এমন পরিবর্তিত বাস্তবতায় সমাজতন্ত্রীরা কী করতেন? তারা কী ইরাক-সিরিয়ায় ছুটে যেতেন। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা-সৌদি-ইসরায়েলি ষড়যন্ত্রের মুখে কার্ল মার্ক্সকে নির্ঘাত যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকায় ঠাই দেয়া হতো। যেভাবে কমিউনিস্ট কিউবাকে এখনো সহ্য করতে পারেন না মার্কিন প্রশাসন।
এতগুলো প্রসঙ্গ টানার মূল কারণই হলো, আন্তর্জাতিকতাবাদ। আর আন্তর্জাতিকতাবাদকে মূল্যায়ন করতে গেলে প্রথমেই যার নাম আসে, তিনি হেইনরিখ কার্ল মার্ক্স। জন্ম ১৮১৮ সালে তৎকালীন প্রুশিয়ায় রাইন প্রদেশের ট্রিয়ারে। বর্তমানে বিশ্ব যাকে চেনে জার্মানি হিসেবে। নিজ দেশে চাপের মুখে প্রথমে ফ্রান্স পরে ব্রিটেনে পাড়ি জমান যিনি। লক্ষ্য সাম্যবাদের বাঁশি।
সমাজতন্ত্রের জনক এই কার্ল মার্ক্সের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী আজ। বিপুল উদ্যমে কার্ল মার্ক্সের দ্বিশতবর্ষ জন্মোৎসব শুরু, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া কিংবা ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে।
মার্ক্স বলতেন, পুঁজিবাদী সমাজে বিচ্ছিন্ন কর্মজীবীশ্রেণি গড়ে ওঠে। এর বিপরীতে সাম্যবাদী সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পৃক্ত কর্মজীবী সমাজ গড়ে উঠবে। এর ফলে দূর হবে শ্রেণিবৈষম্য। জার্মান এই দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্ক্স উনিশ শতকের মাঝামাঝি ‘দাস ক্যাপিটাল’ গ্রন্থ রচনা করেন। সেখানে বলা হয়, কীভাবে পুঁজিবাদ পদ্ধতি কাজ করে এবং কেন করে। সেই গ্রন্থে তিনি তাঁর মতবাদকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করেছেন।
কার্ল মার্ক্সের মতবাদ অনুসারে পরিচালিত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলেও চীনে তা দাপটের সঙ্গে টিকে রয়েছে। জার্মানির পূর্বাঞ্চলের অর্ধেক ১৯৪৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ব্লকে ছিল। তবে জার্মানির ওই অংশ পশ্চিমাংশের চেয়ে বেশি দরিদ্র ছিল। ১৯৯০ সালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি এক হয়ে যায়।
দেশান্তরী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী ও মার্ক্সবাদের প্রবক্তা কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে ইউরোপে বিতর্ক থাকলেও চীনে তিনি মর্যাদার উচ্চ আসনে রয়েছেন। চীনের সরকারব্যবস্থা পরিচালিত হয় মার্ক্স তত্ত্বকে অনুসরণ করে। চীনের শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীদের বেশির ভাগের জন্য মার্ক্সবাদের ওপর পড়াশোনা করা বাধ্যতামূলক।
নিজ জন্মভিটে জার্মানির ট্রিয়েরে দু’বছর ধরেই কার্ল মার্ক্স এর ভাস্কর্য উন্মোচন নিয়ে বিতর্ক চলছিলো। অবশেষে সাম্যবাদী নেতা কার্ল মার্ক্সের ২০০তম জন্মবার্ষিকীতে চীনের তৈরি মূর্তিটি তাঁর জন্মস্থান ট্রিয়ের শহরে উন্মুক্ত হচ্ছে।
দুই শতাব্দী পরেও এখনও শোষিত মানুষের ভরসাস্থল কার্ল মার্ক্স। তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে মাও সেতুংয়ের চীন। কার্ল মার্ক্সকে আধুনিক যুগের সেরা দার্শনিক আখ্যা দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনাপিং। বেইজিংয়ের সেন্ট্রাল হলে আয়োজন করা হয় দ্বিশতবর্ষ জন্মোৎসব।
সি চিনপিং বলেন, বিশ্বজুড়ে প্রলেতারিয়েত এবং শ্রমজীবী মানুষের শিক্ষক কার্ল মার্ক্স। মার্ক্সিজমের প্রবক্তা, মার্ক্সিস্ট পার্টির উদ্যোক্তা, আন্তর্জাতিক কমিউনিজমেরও সূচনা তার হাত ধরে। আজকের এই মহান সমাবেশে উপস্থিত সকলেই একজন মহান মানুষের দুশোতম জন্মবার্ষিকী পালনে অংশ নিয়েছে। মহান এই ব্যক্তিত্বের চিন্তনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে বিশ্ববাসী। মানবমুক্তির কল্যাণের জন্য পুরো জীবনকে উৎসর্গ করেছেন মার্ক্স। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে একাই দাঁড়িয়েছেন তিনি। চেয়েছেন নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা। যেখানে থাকবে না শ্রমিকের প্রতি মালিকের শোষিতের মনোভাব।
চীনের প্রেসিডেন্টের দাবি, মার্ক্সের রেখে যাওয়া বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আজকের সংঘাতকবলিত বিশ্বের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যুগ যুগ ধরে মানুষ আত্ম অন্বেষণের বাসনায় যে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাকেই নতুন সূর্যোদয়ের মতো মার্ক্স উন্মোচিত করেন সমাজতন্ত্রে।
মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি ঘোষণা করেছিলেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো। এবছর সেই ইশতেহার গড়ালো ১৭০তম বর্ষে। মানব ইতিহাসে এখনো লক্ষ তরুণকে অনুপ্রেরণাদায়ী এই ঘোষণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই বিশ্বের অনেক দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতন্ত্র। যে আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে,সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হয়েছিলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও কিউবায়।
হয়তো সাংগঠনিকভাবে এখন শক্তিশালী নয় মার্ক্সবাদীরা। তবে মতাদর্শ হিসাবে এখনও বিশ্বে বহুল আলোচিত এই দর্শন। যার প্রথম রূপ বিশ্ববাসী দেখে ১৮৪৮ সালে। বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকে নিয়ে মার্ক্স রচনা করেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো। এরপর দর্শন,রাজনীতি আর অর্থনীতি নিয়ে দুই বন্ধু মিলে রচনা করেন বিশ্বকে বদলে দেয়া একের পর এক বিভিন্ন গ্রন্থ।
বলা হয়, শতবর্ষ আগে রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের ঘোষণা মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদকে নিয়ে আসে চীনে। বিশেষ করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনা বিপ্লব এ অঞ্চলে মার্ক্সবাদের শক্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। চীনের কমিউনিস্ট নেতাদের দাবি, কেবলমাত্র সমাজতন্ত্রই রক্ষা করতে পারে চীনকে । পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় চীনের কমিউনিস্ট পার্টিও মার্ক্সের মূল নীতিকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলছে। বাণিজ্যসহ নানা খাতে আজকের যে উন্নয়নের গতি তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চীনের বর্তমান অবস্থার আলোকেই সাজানো হয়েছে দেশটির সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে।
আফ্রো, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা-পৃথিবীর দেশে দেশে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে আলোচিত মন্ত্র মার্ক্সবাদ। যে আদর্শে ইউরোপ দেখে ভুত, আর পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশে কায়েম হয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
সমাজ পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা। কল্পনা থেকে দর্শনকে যিনি দাঁড় করিয়েছিলেন বাস্তব ভিত্তির ওপর, সেই মনিষী হেইনরিখ কার্ল মার্ক্সের জন্মের পর পেরিয়ে গেছে দুইশো বছর। একমাত্র মুনাফাকে ভিত্তি করে শোষণের দর্শন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে সূচনা করলেন মার্ক্স,আজ তার আবেদন কতোটুকু? মার্ক্স এখনো কতটুকু প্রাসঙ্গিক?
লুসিয়া প্রাডেলা নামে একজন অর্থনীতিবিদ বলছিলেন, আজকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দেখে মার্ক্স মোটেও বিস্মিত হতেন না। আমরা আজকে যা দেখছি-বিশ্বায়ন, উৎপাদন, বাণিজ্য, শ্রমিক অভিবাসন, অনেক কিছুই তিনি অনুমান করে গেছেন।
মার্ক্সকে নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন তাত্ত্বিক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মার্ক্সের দর্শনে কী জাদু? তিনি বলছেন, বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বৈষম্য ও জঙ্গিবাদের সম্প্রসারণ, এসবই পুঁজিবাদের প্রচারণার অংশ। নব্বইয়ের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, অনেকে ভাবেন পতন হয়েছে মার্ক্সবাদের। বিভক্ত হয়ে পড়েন মার্ক্সবাদীরাও। বিশ্বজুড়ে জেঁকে বসে ধর্মীয় উগ্রবাদ। পুঁজিবাদ এখন আরও নির্মম-নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে, আলাদা আলাদা দাবিতে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে কেবল সমাজতান্ত্রিক দর্শনই পারে শোষিত মানুষের শক্তি হয়ে উঠতে। এই গবেষক বলছেন, বর্তমান পৃথিবী যে অবস্থায়, হয় পুঁজিবাদের বিনাশ হবে, অন্যথায় পৃথিবী ধ্বংস হবে। ৯০ জন মানুষ পরিশ্রম করবে, আর ১০ জন মানুষ তার ফল ভোগ করবে, এই পদ্ধতি চলতে পারে না।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ইরাক সিরিয়ার আইএস জঙ্গিরা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু এরা মূলত পুঁজিপতিদেরই মদদপুষ্ট। তাই জঙ্গিবাদী দর্শন পরাস্ত করতে কার্ল মার্ক্সের বিকল্প নেই।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মধ্যবিত্তশ্রেণি থেকে এসেও মার্ক্স নিজেকে সংগ্রামের মাধ্যমে পুরোপুরি শ্রেণীচ্যুত করেছেন। তাই, বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধ-সংঘাত, জঙ্গি তৎপরতা কিংবা শোষণ-বঞ্চনা নির্মূলে এখনো আদর্শ কার্ল মার্ক্সের দর্শন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)