চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ছাত্রলীগের সম্মেলনে সহজ নাকি জটিল সমীকরণ?

নির্বাচনের বছরে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নতুন কমিটি সংগঠনের জন্য ভালো হবে? নাকি অসন্তোষ বাড়বে? দলের মধ্যে এমন দ্বিধাভক্ত অবস্থানের পরেও প্রস্তুতি চলছে নতুন সম্মেলনের।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, সময়মত সম্মেলন হওয়া যেকোনো সংগঠনের জন্যই ইতিবাচক। তাতে সংগঠনে গতির সঞ্চার হয়।

বহু আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া দেশের প্রাচীনতম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলনের সম্ভাব্য তারিখ ১১ মে। যদিও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্ধারিত মেয়াদের ৮ মাস বেশি সময় পার করে ফেলেছে বর্তমান কমিটি।

২০১৫ সালের ২৬ ও ২৭ জুলাই সর্বশেষ সম্মেলনে প্রত্যক্ষ ভোটে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসেন সাইফুর রহমান সোহাগ ও জাকির হোসাইন।

দলটির সভাপতি মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী মে মাসে প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রলীগের সম্মেলন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাগিদ দিয়েছেন।

এরই মধ্যে সম্মেলনের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরতে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে ছাত্রলীগ।

তবে ছাত্রলীগের গত প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সংগঠনের একটি অংশের মধ্য থেকে সম্মেলনের দাবি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে স্পষ্টত দুটি গ্রুপ দেখা যায়।

যারা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন কিন্তু বয়স পেরিয়ে যাওয়ার কারণে আগামী সম্মেলনে কোনো পদে আসতে পারবেন না, শুরু থেকেই তারা সম্মেলনের বিরোধিতা করে নানা যুক্তি তুলে ধরছেন।

এই গ্রুপটির নেতারা বলছেন, এখন সাবেক হয়ে গেলে আওয়ামী লীগের অন্য কোনো সহযোগী সংগঠনে তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ কম। এতে বেশিরভাগ নেতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারই হুমকির মুখে পড়বে।

এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস হাতে রেখে ছাত্রলীগে নতুন কমিটি আসলে সেই কমিটি আওয়ামী লীগের পক্ষে কতটা কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারবে তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ।

তাদের যুক্তি, নতুন কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পর গুছিয়ে উঠতেই ১ থেকে দেড় বছর সময় লেগে যায়। এসব যুক্তি দিয়ে তারা চাইছেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত থাকতে।

এ ব্যাপারে একজন সহ-সভাপতি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের ১১০টি সাংগঠনিক জেলা শাখা রয়েছে।  উপজেলা শাখা আরও অনেক।  নতুন কমিটি আসলে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ হতে হতেই অনেক সময় লেগে যায় শীর্ষ নেতাদের।’

কাজী জাফর উল্ল্যাহ

তাই এখনই নতুন কমিটি আসলে তারা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলের পক্ষে কতটা কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দিহান তিনি।

আর যারা বর্তমানে পদে থাকলেও আসছে সম্মেলনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারবেন তারা দ্রুত সম্মেলন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছেন।  তাদের যুক্তি সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনের মধ্যে যে দ্বিধা-বিভক্তি রয়েছে নতুন কমিটি আসলে সে বিভক্তি দূর হয়ে যাবে।  নতুন উন্মাদনায় সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে দলের স্বার্থে কাজ করতে পারবে।  সংগঠনে সঞ্চার হবে নতুন প্রাণের।

সম্মেলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে একজন যুগ্ম-সম্পাদক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘‘সুস্বাস্থ্য রক্ষায় শরীরের রক্ত যেমন তিন মাস পরপর মরে গিয়ে নতুন করে জন্ম নেয়।  তেমনি নতুন কমিটি আসলে সেটা সংগঠনের জন্যই মঙ্গল। তাতে একদিকে যেমন গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা কিছুটা হলেও রক্ষা হবে, তেমনি নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে সংগঠনে’’।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন, ছাত্রলীগের সম্মেলন হলে সংগঠনের জন্য সেটা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। যা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য কাজে লাগবে।

দলের সভাপতি মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ এ বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমি মনেকরি যে কোন সংগঠনেই সময়মত সম্মেলন হওয়া উচিত। তাতে সংগঠন সচল হয়, গতি বাড়ে।  ছাত্রলীগের সম্মেলন হলেও  তাদের জন্য ভালো হবে।

দেলোয়ার হোসেন

নতুন কমিটি হলে আগামী নির্বাচনে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের পক্ষ আরও বেশি ভুমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।

বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের কথায়।

চ্যানেল আই অনলাইনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক এ সভাপতি বলেন: যারা বলছেন নতুন কমিটি হলে তাদের গুছিয়ে উঠতে সময় লাগবে, তারা আসলে সঠিক বলছেন না। কারণ এখন যারা শীর্ষ নেতৃত্বে আসবে তারাতো নতুন কেউ আসবে না। সংগঠনের মধ্য থেকেই আসবে। দীর্ঘদিন ধরে যারা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থেকে মাঠের রাজনীতি করছেন, মেধা ও দক্ষতা দিয়ে যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন তারাই আসবে শীর্ষ নেতৃত্বে। সুতরাং তাদের গুছিয়ে ওঠার কিছু নেই।তারা ইতোমধ্যেই পরীক্ষিত।

‘‘তাছাড়া বর্তমান কমিটির নেতাদের মধ্যে শিবির বা অনুপ্রবেশকারীর অভিযোগ রয়েছে। তা মুক্ত করার জন্যও সম্মেলন প্রয়োজন। আসছে কমিটিতে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে নেতা নির্বাচন করা হবে, যেন এমন অভিযোগ না ওঠে।’’

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

আওয়ামী লীগ নেতাদের বাইরে রাজনীতি বিশ্লেষকরাও ছাত্রলীগের সম্মেলনকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: শুধু ছাত্রলীগ নয় প্রতিটি সংগঠনের সম্মেলনই নিয়মীত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।  কারণ দুই বছরের কমিটি যদি চার বছরে চলে যায় তাহলে অছাত্রদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ তৈরি হয়, বাদ পড়ে যান নিয়মীতরা।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা নিশ্চয়ই বিচার-বিশ্লেষণ করেই সম্মেলন করার তাগিদ দিয়েছেন। সুতরাং এর মধ্যে নেতিবাচক কিছু দেখি না।

গত শনিবার আ’লীগের কার্যনির্বাহি কমিটির এ সভায়ই মে মাসে ছাত্রলীগের সম্মেলনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসে

সম্মেলন নিয়ে যা হলো
ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে (৪ জানুয়ারি) সামনে রেখে সংগঠনটির সহ-সভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক এবং সম্পাদক পর্যায়ের একাধিক নেতা সম্মেলনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ‘সম্মেলন প্রত্যাশী নেতাকর্মীবৃন্দ’র ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের হাইকমাণ্ডের নির্দেশনায় তারা নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করছেন।

এর পরদিনই আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে ছাত্রলীগের সম্মেলন প্রত্যাশী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতা এনামুল হক শামীম এবং দেলোয়ার হোসেন।  বৈঠকের পর ওই দিনই তারা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করলে তিনি সম্মেলন হবে বলে আশ্বাস দেন।

ওই  বৈঠকের তিন দিনের মাথায়ই গত ৬ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ শোভাযাত্রা উদ্বোধন করতে গিয়ে স্বাধীনতার মাসে ছাত্রলীগের সম্মেলনের ঘোষণা দেন ওবায়দুল কাদের।

সে অনুযায়ী ৩১ মার্চ এবং ১ এপ্রিল সম্মেলন আয়োজনের কথা জানিয়েছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনও।

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ শোভাযাত্রা উদ্ধোধন করতে গিয়ে মার্চে সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের

কিন্তু গত ৮ মার্চ ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসে সম্মেলন স্থগিতের কথা জানান সাংবাদিকদের।

তারা বলেন, ৩১ মার্চের সম্মেলন আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।  যথাসময়ে সম্মেলন আয়োজন করা হবে এবং সবাইকে জানানো হবে।

নতুন করে আগামী মে মাসে সম্মেলনের ঘোষণা আসার পর ছাত্রলীগের একাংশ সম্মেলনকে স্বাগত জানালেও অপর অংশ মনে করছে নতুন কমিটি এলে নির্বাচনের আগে এত অল্প সময়ের মধ্যে গুছিয়ে উঠতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

এরপর নানা জল্পনা কল্পনার পর গত শনিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় তাগিদ আসে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে সম্মেলন আয়োজনের।

ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে ছাত্রলীগ। আত্মপ্রকাশের পর বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় সংগঠনটি।