জাতীয় সম্মেলনের পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা না হওয়ায় অনিশ্চয়তায় পড়েছেন সংগঠনটির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। অস্থিরতা বিরাজ করছে প্রার্থীদের মধ্যেও। নানা গুজব ছড়াচ্ছে কমিটি নিয়ে। এমনকি ‘চরিত্র হননের’ শিকার হচ্ছেন নেতা হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা কয়েকজন প্রার্থী।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে ছাত্রলীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক ইউনিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলন হলেও ঘোষণা করা হয়নি কমিটি।
চলতি মাসের ১১-১২ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হয় সংগঠনটির ২৯তম জাতীয় সম্মেলন। গত ২৪ এপ্রিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, ২৬ এপ্রিল ঢাকা মহানগর উত্তর ও ২৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীরা বলছেন, আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক শেখ হাসিনা নিজে কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; তাই আমরা আশাবাদী। তিনি যাদের যোগ্য মনে করবেন, দায়িত্ব দেবেন। আমরা তাদের নেতৃত্বেই সংগঠন ও দলের জন্য কাজ করে যাবো।
এক রকম অনিশ্চয়তার কথা উল্লেখ করে নেতাকর্মীরা মনে করছেন, কমিটি নিয়ে যেসব গুজব সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে, দ্রুত কমিটি ঘোষণা করলে তা কেটে যাবে এবং নেতাকর্মীরা যে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে তা দূর হবে।
‘চরিত্র হননের’ শিকার প্রার্থীরা
আলোচনায় থাকা কয়েকজন প্রার্থীর নামে প্রায় প্রতিদিনই উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক তথ্য দিয়ে বিভিন্ন নাম সর্বস্ব অনলাইন পোর্টালে খবর বের হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফেসবুকে বিভিন্ন নামে খোলা হয়েছে একাধিক পেজও। নামে-বেনামে বিভিন্ন ভূয়া আইডি থেকে সেইসব অনলাইন পোর্টাল এবং পেজ থেকে ওইসব ‘খবর’ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
এরই মধ্যে এ ধরনের ঘটনার শিকারে পরিণত হয়েছেন আলোচনায় থাকা চট্টগ্রামের আদিত্য নন্দী, কুড়িগ্রামের রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং চাঁদপুরের মাজহারুল ইসলাম শামীম। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
আদিত্য নন্দীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পড়াশুনায় অনিয়মিত থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগও ছড়ানো হয় তার বিরুদ্ধে।
তবে তার ছাত্রত্ব থাকার প্রমাণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে আদিত্য নন্দীর বিবিএ পাসের সনদও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন তার অনুসারীরা।
বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সহ-সভাপতি আদিত্য নন্দী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছড়ানো হয়েছে, তা ইতোমধ্যেই ভিত্তিহীন বলে সামাজিক মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি অরো বলেন: দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগকে একটি গোষ্ঠী ভুলপথে এবং নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে আসছিল। যখন দেখেছে তাদের সেই কর্তৃত্ব হারানোর পথে, তখনই তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে। সামাজিকভাবে আমাকে হেনস্থা করার চেষ্টা করছে। এর জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিচার দাবি করছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণের শিকার আরেক প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় নন। প্রচার আছে মাদক গ্রহনেরও। এমনকি তার নানা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সংগঠন শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলেও প্রচার করছে কেউ কেউ।
তবে ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির এ সদস্য চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে যখন আমার মুক্তিযোদ্ধা নানাকে রাজাকার বানিয়ে আমার সংগঠনের লোকজনই অপপ্রচার করে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় আমার পরিবার কী পরিমাণ নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তা যে কেউ এলাকায় খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।
রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, আমি সবসময়ই রাজনীতির মাঠে ছিলাম। হলের বর্ধিত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আপ্যায়ন সম্পাদক ছিলাম এবং সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও ছিলাম।
‘একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে আমি সবসময়ই মাঠে ছিলাম। কিন্তু নেতাকর্মীদের ভিড় ঠেলে সামনে যেতে পারিনি বলে হয়তো আমার ছবি ওইভাবে প্রচার হয়নি।’
মাজহারুল ইসলাম শামীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গত ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তার পরিবারের অনেকেই বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত।
এ বিষয়ে বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির প্রশিক্ষণ বিষয়ক এ সম্পাদক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমার পরিবার সম্পর্কে সব তথ্যই প্রাথী হিসেবে দেয়া জীবনবৃতান্তে দেওয়া আছে। চাইলে যে কেউ খোঁজ নিতে পারেন। আপনি দেখবেন, যেদিন যার নাম আলোচনায় আসছে, তাকে টার্গেট করেই বিভিন্ন ভুঁইফোড় অনলাইনে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হচ্ছে।
কাটেনি বয়স অনিশ্চয়তা:
ছাত্রলীগের কমিটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একটি সূত্র জানায়, বিদায়ী সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন বয়স ২৮ রাখার পক্ষে। তারা এই বয়স বহাল রাখার জন্য চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত ১১ মে ছাত্রলীগের ২৯তম অধিবেশন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বয়স ২৭ বছর। কিন্তু সম্মেলন ১০ মাস বিলম্ব হওয়ায় এক বছর গ্রেস দিয়ে ২৮ করা হলো।
প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পর শুক্রবার রাতে গণভবনে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বয়স আরও এক বছর বাড়ানোর দাবি করেন।
ওই সভা শেষে একাধিক নেতা শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বয়স ২৮ বছর ৩৬৪ দিন করা হয়েছে।
এরপর নির্বাচন কমিশন সম্মেলনের আগে শুক্রবার দিনগত রাত দেড়টার পরে শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী বয়স ২৮ বছর ধরে বৈধ প্রার্থীদের তালিকা ছাত্রলীগের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরিফুর রহমান লিমনের ফেসবুক ওয়ালেও প্রকাশ করে।
সেখানে ১৯৯০ সালের ১১ মের আগে যাদের জন্ম তাদের প্রার্থীতা বাতিল করে তালিকাও প্রকাশ করা হয়।
এছাড়াও শনিবার সকালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ২য় অধিবেশন শুরু হলে লিমন আবারও ঘোষণা দেন, যাদের বয়স ১৯৯০ সালের ১১ মে’র পরে তাদের প্রার্থীতা বাতিল করা হয়েছে।
কিন্তু একটি পক্ষ ২৮ বছর ৩৬৪ দিনের পক্ষে অবস্থান নেয়। এরপর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সম্মেলন স্থলে এসে বলেন, যেহেতু কোনো সমঝোতা হচ্ছে না, তাই গণভবনে যাওয়া উচিৎ। এরপর তারা বিদায়ী সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইনকে নিয়ে গণভবনে যান।
গণভবনে যাওয়ার পর কমিটি ঘোষণা আরও কয়েকদিন পিছিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃবৃন্দকে জানান, কমিটি তিনি নিজেই দেবেন।