প্রবেশ পথেই মন হারাবেন আপনি। ভূমি অফিসের আঙ্গিনা জুড়ে স্বাধীনতার ঘ্রাণ, মুক্তিযুদ্ধের সরব কথকতা।মনে মনে ভাববেন, ভূমি অফিসের বদলে অন্য কোথাও এলাম নাকি! ঠিক এমনই অনুভূতি দেবে যশোরের অভয়নগরের উপজেলা ভূমি অফিস।
দেশের প্রথম এবং একমাত্র ভূমি অফিস হিসেবে অভয়নগরে গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক থিমপার্ক- স্বাধীনতা অঙ্গন। আমি যখন অভয়নগরের সহকারী কমিশনার ভূমি বা এসি ল্যান্ড। তখনই এমনি কিছু করার চিন্তা আসে।
ব্যক্তিগত উদ্যোগ আর উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের প্রতক্ষ্য অংশগ্রহণে মাত্র ১ মাসেই গড়ে তোলা হয় অনন্য এই পার্কটি। মূলত তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে ও ভূমি অফিসের সাথে পরিচিত করতেই গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা অঙ্গন।
দেশের প্রায় সব ভূমি অফিসেই এখন বিভিন্ন উদ্ভাবনী শুদ্ধাচারের প্রচলন হয়েছে। তবে এ অফিসটি হেঁটেছে সম্পূর্ণ নতুন পথে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তারুণ্য বান্ধব নানান মাধ্যমে। দেয়াল জুড়ে জেলার মুক্তিযুদ্ধের ছবি, তথ্য বোর্ড, ভাস্কর্য, ম্যুরাল… আরও কত কি!
দেশের প্রথম শব্দটা আরও একটি বিষয়ের সাথে মিলে যায়। মুক্তপাতা। দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মুক্ত আকাশ পাঠাগার। চলুন স্বপ্নদ্রষ্টার কলমেই জেনে নেই স্বাধীনতা অঙ্গনের বাকিটুকু:
গত বছরের মার্চে এসি ল্যান্ড হিসেবে যোগদান করতে গিয়ে প্রথম দিনই হোঁচট খাই কিছুটা। প্রাঙ্গনটা ঝোপ-ঝাড় আগাছা আর অভিযানে জব্দ করা ভেজাল সারের বস্তায় ভর্তি।
মন ভাঙ্গেনি। মন গড়েছিলাম ‘কিছু একটা’ গড়ার প্রত্যয়ে।
‘ভূমি অফিসের কাজের ব্যস্ততায় কিছু করাই নাকি কঠিন হবে’ পিছুটান কয়েকজন স্টাফের।
তবে, বাকি কয়েকজন একটা প্রস্তাব দেন, ‘বাগান করেন স্যার।’
মন বাধ সাধে। বোবা প্রাঙ্গনটাকে চেয়েছিলাম সরব করতে। এমন কিছু করতে যাতে অাঙ্গিনাটা কথা বলে, কিছু শেখায়।
তিন-চারদিন অফিস করার পর আরেকটা বিষয় নজরে এলো। ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা মানুষগুলো হয় বৃদ্ধ না হয় মাঝবয়েসি। তরুণ প্রজন্ম এখানে হিসেবের খাতা থেকে এক কথায় বাদই বলা যায়।
স্বপ্ন এখন দ্বিগুণ। বোবা প্রাঙ্গনকে ভাষা দেয়া আর তরুণ প্রজন্মকে তাদের মতো করে ভূমি অফিস চেনানো। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আর মাতৃভূমির মমত্বে উদ্ধুদ্ধ করা।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাইনি। উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ আর একজন ভাস্কর নিয়ে নেমে পড়ি কর্মযজ্ঞে।
প্রথম তিনদিন লেগে যায় শুধু জঙ্গল আর আবর্জনা পরিষ্কারেই। এলাকার সবাই এগিয়ে এসে যার যার জায়গা থেকে সহযোগিতা করতে থাকে। তাদের কথা একটাই ‘এটা তো আমাদেরই থাকবে’
টানা ১৫ দিন পরিশ্রম করে যশোর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ছবি সংগ্রহ করি হার্ড আর সফট কপিতে। প্রায় অর্ধশত।
সব ছবিগুলোর বড় আকারের প্রিন্টেড কপি সেঁটে দেয়া হয় জীর্ন দেয়ালের গায়ে। নতুন এ দেয়ালিকাই প্রাঙ্গনকে সরব করে সবার আগে। মনিহারের পাশে গণহত্যা থেকে সম্মুখযুদ্ধ এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যশোর সফরকালের ছবিও ফুটে ওঠে ‘দেয়াল ৭১’ এ।
এবার দেয়ালকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয় ইটের রাস্তা। ‘রোড টু ফ্রিডম’
শুধু মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে মন ভরছিলো না। ভাস্কর অনন্ত হ্যাপিকে নতুন কর্মযজ্ঞে নামালাম। তিন দিনের মধ্যে তৈরি হলো গণহত্যার স্মৃতি ভাস্কর্য ‘স্মৃতিতে ৭১।’
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো জানাতে তৈরি হলো কংক্রিটের মানচিত্র। আমাদের মুক্তির পথে যাত্রাটা পাহাড়ে আরোহনের মত কঠিন পথ ছাড়া আর কি! সে পথের প্রতিটা ঘটনা বোঝাতে গড়ে তুলেছি ‘পর্বত চেতনা।’ যার প্রতিটি খাঁজে লেখা আছে ৫২ থেকে ৭১ এর ঘটনাগুলো।
ইদানিং ফেসবুক, ইউটিউবে ভিডিও দেখি ভিডিও ভাইরাল: জাতীয় দিবসগুলো জানে না জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা! সেই কষ্ট থেকেই বানিয়েছি ‘দিবস বাতায়ন’ স্বাধীনতা অঙ্গনের ঢোকার মুখে দিবস বাতায়নের একটি বোর্ড। দিবসের নাম লেখা। কিন্তু উত্তর নেই। উত্তর মিলবে এর জমজ ভাইয়ের কাছ থেকে: বের হওয়ার সময়, আরেক বোর্ডে।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ শাহাদাত বরণ করেন যশোরে। মৃত্যুর মাধ্যমে যে সম্পর্ক তা ফুটিয়ে তুলতে তৈরি করেছি ‘বীরের দুয়ার’। আছে নুর মোহাম্মদ শেখের ম্যুরাল আর বীরের জীবন কথা।
অঙ্গনটিতে স্বাধীনতার আর ২৬ মার্চকে ভুলে গেলাম? ভুলে যাই নি। ফোয়ারা ও ভাস্কর্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সরোবর ২৬’ পাশের বোর্ডেই মিলবে ২৬ মার্চের তাৎপর্য।
স্বাধীনতা অঙ্গনের গর্ভেই গড়ে তুলেছি আরেক অনন্য সৃষ্টি।
দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মুক্ত আকাশ পাঠাগার ‘মুক্তপাতা’ সেখানে খোলা আকাশের নিচেই হবে পাঠকের বই পড়া। বইগুলো লেমিনেটিং করা। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে ওভাবেই থাকে বইগুলো। বাংলাদেশে তো প্রথম আর বিশ্বে এমন উদাহরণ দ্বিতীয়।
বের হওয়ার পথটাতে উদ্ধৃতি চিহ্ন বা কোটেশন মার্কের মতো বসার যায়গা। নাম দিয়েছি ‘শূন্য পয়েন্ট’। কারণটা সহজ। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের নিভে যাওয়ায় শোকে আমাদের উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে বক্তব্য শূণ্য। অর্থাৎ নীরবতা।
এই অঙ্গনেই গড়ে তোলা হয়েছে পাখিদের অভয়ারণ্য ‘বিজয় বিহঙ্গ’।
আমার অঙ্গনটা আজ কথা বলতে শিখেছে। গাইছে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর মাতৃভূমির গান। তরুন প্রজন্ম শয়ে-শয়ে আসে স্কুল ছুটির পর। অভয়নগরের স্কুলগুলোর একটি করে ক্লাস হয় স্বাধীনতা অঙ্গনে। ওরা আসে, ওরা শেখে, সেই সাথে চেনে ভূমি অফিসকে।
আমি থাকবো না। রয়ে যাবে মোর এক টুকরো স্বাধীনতার স্বাদ আর মাতৃভূমির মমত্বে গড়া স্বাধীনতা অঙ্গন।
সময় পেলে ঘুরে আসতে পারেন স্বাধীনতা অঙ্গনে। যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রাণকেন্দ্রেই এ অঙ্গন আপনাকে দিতে পারে স্বাধীনতার নতুন স্বাদ।