কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতনে উৎসবের কোনো কমতি নেই। বলা যায়, পুরো বছরই উৎসবমুখর থাকে। রবীন্দ্র জন্মোৎসব ও তিরোধান বা বৃক্ষরোপণ দিবস, পৌষমেলা, বসন্ত উৎসবসহ বিভিন্ন ঋতুগুলো বেশ ঘটা করে উদযাপন করা হয়। এর বাইরেও আছে রকমারি উৎসব। এসবকে কেন্দ্র করে সংগীত, নৃত্য, নাটক, আবৃত্তিসহ নানামুখী কর্মকাণ্ডে বছরভর মুখর থাকে এ আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র। শান্তিনিকেতনে যাঁরা যেতে চান, তাঁরা সাধারণত কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করেই বোলপুরে রওয়ানা হন।
কিন্তু ফেব্রুয়ারির শুরুতে আমরা যখন আশ্রমে পোঁছাই, সেখানে কোনো উৎসব ছিল না। আনন্দ ছিল না। খুব বেশি জনসমাগমও ছিল না। বরং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংরক্ষণ প্রথা তুলে দেওয়ায় চলছিল কঠিন ধর্মঘট। যে কারণে সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল না। এমনিতেই উৎসববিহীন শান্তিনিকেতন, তার ওপর ধর্মঘট, এমন অবস্থায় অনেক দূর থেকে সেখানে যেয়ে যে কারোই মুষড়ে পড়ার কথা। তবে আমরা মোটেও হতোদ্যম হই নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শান্তিনিকেতন আমাদের জীবনে অন্য রকম ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে। তার প্রতি আবেগময় এক আকর্ষণ অনুভব করি। সঙ্গত কারণে জীবনে প্রথমবার শান্তিনিকেতন যাওয়াটাই ছিল আমাদের কাছে বড় উৎসব। অন্য কিছু সেই উৎসবকে ম্লান করতে পারে নি।
হাওড়া স্টেশন থেকে যখন ‘শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস’-এ উঠি, তখন থেকেই বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। এটি আরো বেশি আনন্দময় হয়ে ওঠে, একজন স্মার্ট অন্ধ ভিক্ষুক গায়কের কল্যাণে। অনেকটা পথ তিনি একটির পর একটি রবীন্দ্র সংগীত গাইতে থাকেন। ট্রেনের দোলন আর সুরে সুরে মজে যাই। এছাড়া পথের দুই পাশ দেখছিলাম বুভুক্ষু নয়নে। এ পথ দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত কতবার যাতায়াত করেছেন। আশপাশের বাড়ি-ঘর, গাছ-গাছালি, আলো-হাওয়া, জীবনযাত্রা তাঁর মনকে নিশ্চয়ই প্রভাবিত করেছিল। তা থেকে মেতেছেন সৃষ্টির আনন্দে। মনের চোখে সেটা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম।
সেটা অনুভব করতে করতে প্রায় ঘণ্টা তিনেকের জার্নি কখন যেন ফুরিয়ে যায়। তখনও মাঘ মাস পুরোপুরিভাবে শেষ না হলেও কড়া রোদ আমাদের অভ্যর্থনা জানায়। তারপরও এককালের ভুবনডাঙার লালমাটি স্পর্শ করার পর মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। নামার পরই মনে হচ্ছিল চারদিকে যেন ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিশ্বাস-প্রশ্বাস। সেখান থেকে টেম্পোতে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে দিতে পাচ্ছিলাম লালমাটি আর সবুজের হাতছানি। মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম গন্তব্যে।
প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠেছে শান্তিনিকেতন। সেখানে পৌঁছানোর পর একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাই। সবটাই মনে হতে থাকে অনেক দিনের চেনা। চাক্ষুষ হয়তো কখনো দেখি নি (টেলিভিশন, বইপত্র-এ দেখার কথা বাদই দিলাম), তবে মনের চোখে তো কম দেখা হয় নি। তার সঙ্গে একটু একটু করে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। পেশাদার গাইড সঙ্গে থাকায় বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাই। ভদ্রলোকের এটা রুটি-রুজি হলেও যেভাবে হৃদয়গ্রাহীভাবে সব কিছু তুলে ধরছিলেন, তাতে বুঝতে পারা যায়, তাঁর হৃদয়জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৮৬২ সালে রায়পুরের জমিদারের আমন্ত্রণে রবি ঠাকুরের পিতা ব্রাহ্মণ সমাজের নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দু’টি ছাতিম গাছ দেখে সেই গাছের তলায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এখানেই তিনি ‘আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’ পেয়েছিলেন। জায়গাটা তাঁর এত ভালো লেগে যায় যে রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে গ্রহণ করেন ২০ বিঘা জমি। সেই জমিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন উপাসনার জন্য দোতলা একটি বাড়ি। তাঁর নামকরণ করেন ‘শান্তিনিকেতন’। পর্যায়ক্রমে পুরো এলাকাই পরিচিত হয়ে ওঠে এ নামে।
১৮৭৩ সালে ১২ বছর বয়সে এখানে প্রথম আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপর থেকেই তাঁর ছিল নিয়মিত যাওয়া-আসা। ১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর গড়ে তোলেন ব্রহ্ম বিদ্যালয়। সেই সময় থেকে জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটে যায় যায় শান্তিনিকেতনে। সবাইকে আমন্ত্রণ জানান এই তীর্থকেন্দ্রে, ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে/এসো করো স্মান নবধারাজলে’।
‘প্রাণের মধ্যে জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা’র লক্ষ্য নিয়ে বিদ্যালয়টি রূপান্তরিত করে ১৯১৯ সালে ১৮ জুলাই গড়ে তোলা হয় ‘বিশ্বভারতী’। রবীন্দ্রনাথের ভারত ভাবনা ও বিশ্ব ভাবনার মিলিত রূপই এই বিশ্বতীর্থ। এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই ছিল তাঁর স্বপ্ন: ‘এখানে বিদ্যা আহরণ ও জ্ঞানচর্চার জন্য বিচিত্র মানব আসিয়া একটি নীড় বাঁধিবে’। পরবর্তীতে এটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।
এখানকার জীবনদর্শন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারজয়ী চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ। এছাড়া কত কত বিখ্যাত জনের পদস্পর্শ লেগে আছে এখানকার মাটিতে। সেইসঙ্গে শান্তিনিকেতন থেকেই একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে উনিশ শতকের নবজাগরণের আলো।
শান্তিনিকেতনের ছায়াবীথিতলে একে একে পরিচিত হই ছাতিমতলা, বকুলবীথি, শান্তিনিকেতনের বাড়ি, উপাসনাগৃহ বা মন্দির, তালধ্বজ বাড়ি, তিনপাহাড়, আম্রকুঞ্জ, দেহলি, গৌরপ্রাঙ্গণ ও ঘণ্টাতলা, গৌরমঞ্চ, শমীন্দ্র শিশু পাঠাগার, পাঠভবনের অফিস, চৈতি, ছাত্রী নিবাস, ব্ল্যাক হাউজ, সংগীত ভবন, কলাভবন, মালঞ্চ বাড়ি, নাট্যঘর, নন্দন ইত্যাদির। এছাড়া দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবাসস্থল উদয়ন, কোণার্ক, উদীচী, বেনুকুঞ্জ, দিনন্তিকা চা চক্র, সন্তোষালয়, চীনাভবন, হিন্দিভবন, দ্বিজবিরাম। দেখতে দেখতে মনের মধ্যে বাজতে থাকে, ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো’।
হায়! ঠাকুর তো নেই। কে খুলে দেবেন ঘরের দরজা? প্রতিটি ভবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস। ধর্মঘটের কারণে রবীন্দ্র মিউজিয়ামে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। সময় না থাকায় যেতে পারি নি ডিয়ার পার্ক, আমার কুঠির, শ্রীনিকেতন, খোয়াই এর মতো দর্শনীয় স্থানে।
‘সেই নিভৃতে, সেই নির্জনে, সেই বনের মর্মরে, সেই পাখির কূজনে, সেই উদার আলোকে, সেই নিবিড় ছায়ায়’ ক্ষণিকের অতিথি হয়ে শান্তিনিকেতনের বিশ্বপ্রকৃতির সুর আর মানবাত্মার সুর অনুধাবন করা মোটেও সহজ নয়। সেই চেষ্টাও করি নি। কেবল অবলোকন করেছি তাঁর কীর্তি, তাঁর সৃষ্টি, তাঁর স্বপ্নকে। চোখের আলোয় যেটুকু দেখা, সেটুকুই অন্তরে গেঁথে নিয়ে এসেছি। যদিও মনটা সেখান থেকে সরে আসতে চাইছিল না। ফেরার সময় বুকের মধ্যে গুঞ্জরিত হচ্ছিল, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার’। মনটা ফেলে এলেও ফিরে এসেছি রবির ভুবনভরা আলোর ছোঁয়া নিয়ে
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)