মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে সমর্যাদায় উদ্যাপিত হয় ‘মা দিবস’। প্রত্যেক মানুষের জীবনে মায়ের অবদান তুলনাবিহীন। মানব জীবনে মায়ের এই অদ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন গ্রন্থে, মনীষীদের রচনায়, সমাজ বিজ্ঞানে বহু যুগ পূর্ব থেকে। অবশেষে গঠিত হয় ‘মা দিবস আন্তর্জাতিক সমিতি’ (Mother Day Intentional Association)।
সমিতি সমগ্র দুনিয়ার যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে ঐ তাৎপর্যমণ্ডিত দিবসটি যাতে পালিত হয় তার জন্য ১৯১২ সালের ১২ই ডিসেম্বর শুরু করে তার শুভযাত্রা। ঐ সমিতির সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রতি বছরে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার চিহ্নিত হয়েছে ‘বিশ্ব মা দিবস’ উদ্যাপনের মর্যাদায়। তখন থেকে ঐ দিনটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে আসছে।
হিন্দু শাস্ত্রে আছে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়ষী’ (জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গ থেকে অধিক গরিমাযুক্ত)। মহাভারতে কথিত আছে অর্জুন সহধর্মিনী সুভদ্রার গর্ভে যখন অভিমুন্য, তখন যুদ্ধের যে কৌশলগুলি তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, মাতৃগর্ভে থেকে অভিমন্যু সেগুলি রপ্ত করেছিল। শত্রুর চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল যখন অর্জুন ব্যাখ্যা করছিলেন, তখন সুভদ্রা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সে জন্য অভিমন্যু সেই কৌশল রপ্ত করতে না পারার জন্য পরিণত বয়সে যুদ্ধে কৌরবদের চক্রব্যূহে অভিমন্যু নিহত হয়। বিষয়টি অবাস্তব এবং কাল্পনিক বলে অনেকে উড়িয়ে দেন। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation) বহু গবেষণা করে যে সত্য আবিষ্কার করেছে, সেখানে বলা হয়েছে মাতৃ গর্ভে শিশু যে দশ মাস থাকে, ঐ সময় শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন ইমারতের ভিত্তি রচিত হয়। সে জন্য মানব শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য, মন, পরিবেশ যাতে সুন্দর থাকে তার জন্য যত্নবান হওয়া আবশ্যিক।
মানব জীবনে মায়ের মর্যাদা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছিলেন, মায়ের চরণতলে প্রত্যেক মানুষের বেহেস্ত।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জননীর দ্বারে আজি ওই শুন গো শঙ্খ বাজে।/থেকো না থেকো না, ওরে ভাই, মগন মিথ্যা কাজে।/অর্ঘ্য ভরিয়া আনি ধরো গো পূজার থালি,/রতন প্রদীপখানি যতনে আনো গো জ্বালি,/ভরি লয়ে দুই পানি বহি আনো ফুলডালি।/মার আহ্বানবাণী রটাও ভুবন মাঝে।’
ইংরেজি ভাষায় বিখ্যাত কবি জর্জ বার্কার ‘To My Mother’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘Most near, most dear, most loved and most far, under the window where I often found her sitting as huge as Asia, seismic with laughter. She is a procession no one can follow after.’ ১৯০৬ সালে ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘Mother’ প্রকাশ করেছিলেন-আর তার উপর ভিত্তি করে V.I.Padovkin ১৯২৬ সালে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন তা দেখে বিশ্ববাসী হয়েছিলেন মুগ্ধ।
বিশ্বে এমন কোনো ভাষা নেই, যেখানে মাতৃবন্দনা, মাতৃস্তুতিতে সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়নি। মানুষ আবেগ তাড়িত হননি। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, তিনি বিদ্যাসাগর হতে পারতেন না যদি ভগবতীদেবী তাঁর জননী না হতেন।
বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা ইংরেজি। ব্রিটিশ কাউন্সিল একবার ইংরেজি ভাষার শব্দরাজির মধ্যে কোন্ শব্দটি সর্বাধিক জনপ্রিয় তা নির্ণয় করার জন্য বিশ্বব্যাপী একটি সমীক্ষা পরিচালিত করে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ইংরেজি ভাষায় প্রচলিত শব্দরাজির মধ্যে বিশাল ব্যবধান নিয়ে সর্বাধিক মাধুর্যমণ্ডিত (sweetest) শব্দ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে একটি শব্দ-মা (Mother)। বিশ্বের বহু স্বনামধন্য ব্যক্তি আত্মজীবনী লিখে বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়ে গেছেন। তাদের প্রায় সবাই মার অমূল্য অবদানের কথা সশ্রদ্ধভাবে উল্লেখ করেছেন। বিদ্যুতের বাল্ব আবিষ্কর্তা টমাস এডিসন লিখেছেন-‘মা মাঝে মাঝে সস্নেহে বলতেন, আমি গর্বিত, তুমি বিদ্যুতের বাল্ব আবিষ্কার করেছ-বাছা ঠিক আছে, এখন আলো বন্ধ করে ঘুমোতে যাও।’ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন লিখেছেন মা কীভাবে তাঁর চুল, তাঁর গোফের প্রতি যত্ন নিতেন। তাকে আদর করতেন। আব্রাহাম লিঙ্কন লিখেছেন তাঁর মা ভালো টুপি পরার জন্য সস্নেহে কীভাবে পীড়াপীড়ি করতেন। একজন কবি বলেছেন ‘Who can fathom the depth of a mother’s love’ (মায়ের ভালোবাসা কে পরিমাপ করতে পারে)। উল্লিখিত আত্মজীবনীতে যে ঘটনাগুলির উদ্ধৃতি দেওয়া হলো, তা অতীব তুচ্ছ, কিন্তু সন্তানের প্রতি জননীর স্নেহ, দরদ, ভালোবাসা যে কত গভীর, তা-ই ঐ কথাগুলির মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে, সে জন্যই বিশ্ববিখ্যাত মনীষীগণ তাদের আত্মজীবনীতে তার উল্লেখ করেছেন।
যারা অল্পবয়সে মাতৃহারা হয়েছেন, তাদের আবেগ প্রতিফলিত হয়েছে, এমন একটি গানের কলি উল্লেখ করতে বড় ইচ্ছা হচ্ছে। সদ্য মা-হারা শিশুর অশ্রু-সিক্ত আকুতি ‘ও তোতা পাখি রে, শিকল খুলে উড়িয়ে দেব, আমার মা কে যদি এনে দাও, ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলে, কখন যে মা গেল চলে, ও তোতা পাখি রে, আমার মাকে যদি এনে দাও।’
মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হলে একটি গানের কথা উল্লেখ করতেই হয়। ‘মধুর আমার মায়ের হাসি, চাঁদের মুখে ঝরে,/মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।/তাঁর ললাটের সিঁদুর নিয়ে ভোরের রবি ওঠে,/ও তাঁর আলতা পরা পায়ের ছোয়ায়, রক্তকমল ফোঁটে।/প্রদীপ হয়ে মোর শিয়রে, কে জেগে রয় দুঃখের ভরে/সেই যে আমার মা,/বিশ্বভুবন মাঝে তাহার নাই কো তুলনা, সেই যে আমার মা।’
প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। মাকে বাদ দিয়ে সন্তান হয় না, মানুষ হয় না। মাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা করার শিক্ষা পুরো মানবজাতিকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা করারই নামান্তর। মানব সম্পদের যথার্থ বিকাশ এবং মানব সমাজের সার্বিক অগ্রগতির জন্য মাতৃজাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্বশীলতার মানসিকতা সৃষ্টির জন্য গোটা সমাজকে সক্রিয় হতে হবে-এই শপথগ্রহণ হোক আজকের সকলের পবিত্র কর্তব্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)