ছোটবেলা থেকেই সবুজের প্রতি টান অবসরপ্রাপ্ত বিমা কর্মকর্তা আবুল আজহার কামরুজ্জামানের। কিন্তু ব্যস্ত জীবনে সুযোগ হয়নি সবুজের সঙ্গে মিশে থাকার। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ২০০৩ সালে ঢাকার গুলশান ১ এর ১১৬ নম্বর রোডের ৪৪বি ছ’তলা ভবনটি গড়ে তোলেন তিনি।
বাড়িটি নির্মাণের সময়ই তার মনে জেগে ওঠে সবুজের সঙ্গে থাকার স্বপ্ন-সাধ। বাড়ির ছাদে দুটি গোলাপ গাছ লাগাতেই ফিরে পান কৃষির প্রতি টান।
‘আমি যখন ২০০৩-এ এই বাড়িটা করি, তখন দু’টো গোলাপ ফুলের গাছ লাগাই। সেই গোলাপ ফুলের আকর্ষণটাই আমাকে এই বাগান পর্যন্ত এনেছে,’ বলেন এ এ কামরুজ্জামান, ‘প্রতিদিনই এখান থেকে ২ কেজির মতো ফুলফল পাই।’
এখন ২ হাজার ৪’শ স্কয়ার ফিটের এই ছাদ দু’স্তরে প্রায় শতাধিক প্রজাতির গাছপালা শাক সবজিতে শোভিত হয়ে আছে। ইজিপশিয়ান ডুমুর থেকে দেশীয় কলা – সবই উৎপাদন হচ্ছে এখানে। বেদানা, সজনে, লাউ, লেবু, সরিষা, পালং, বারোমাসি আমড়া, ড্রাগন, বেগুন, নিম, লেটুসপাতা, আনারসসহ অসংখ্য ফল-ফসলে ছেয়ে আছে ছাদটি। যা দেখে বোঝাই যায় না এটি নগরের কোনো অভিজাত পল্লী। যেনো এক টুকরো উর্বর কৃষিক্ষেত্র।
প্রতি মৌসুমেই এখানে উৎপাদন হচ্ছে নানারকম বিষমুক্ত ফলমূল ও শাকসবজি। যা দিয়ে মিটে যাচ্ছে পরিবারের দরকারি কৃষিপণ্য চাহিদা।
ছাদের ঠিক নিচের তলায়ই পরিবারসহ থাকেন এ এ কামরুজ্জামান। জানান, ছাদে এই বাগানের কারণে নিচে তার বাসা আগের চেয়ে অনেক ঠাণ্ডা থাকে। অনেক অক্সিজেন পান এই ছাদ কৃষির কারণে।
(ডানদিক থেকে: এ এ কামরুজ্জামান, শাইখ সিরাজ, কামরুজ্জামানের ভাগ্নী কানিজ রসুল ফারুকি)
জনাব কামরুজ্জামান সারাটি জীবন ব্যস্ততা আর যান্ত্রিকতার ভেতর কাটিয়ে এখন অবসর জীবনে এসে খোঁজেন শান্ত শীতল পরিবেশ। সেক্ষেত্রে এই ছাদ কৃষিই এখন তার মূল ঠিকানা। এই সবুজ প্রকৃতি প্রতিদিন তাকে দেয় নতুন প্রাণশক্তি।
কৃষির টানে নিয়মিত ছাদে ছুটে আসেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। তাদের কাছেও ছাদটি প্রিয় এক ক্ষেত্র। তারাও এখন বুঝে গেছে যে, নগর জীবনে পরিবেশ রক্ষা ও বাসার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ছাদকৃষি এখন সময়োপোযোগী উদ্যোগ।
কামরুজ্জামান এখন আর আগের মত ছাদ-কৃষির সব কাজে অংশ নিতে পারেন না। তার তত্ত্বাবধানে কাজ করেন দুজন কর্মী। তারাও কৃষির বিভিন্ন কৌশলের সঙ্গে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পেরেছে।
ছাদ কৃষি কৌশল গতানুগতিক চাষ কৌশল থেকে একটু আলাদা। এখানে মাটি, পানিসহ সবকিছু একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় হতে হবে। অর্থাৎ সীমিত পরিসরে সীমিত উপকরণ দিয়েই সবকিছু উৎপাদন করতে হয়। এর জন্য দরকার হয় বিজ্ঞানসম্মত জানা-বোঝা।
বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা দিতে ও সম্প্রসারণ করতে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি সংগঠন। যারা আগ্রহীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকে। কামরুজ্জামানের ছাদ কৃষিতে সহযোগিতা করেছিলেন এমন একজন সংগঠক গোলাম হায়দার।
বাংলাদেশ গ্রীন রূফ মুভমেন্ট সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম হায়দার জানান, এক্ষেত্রে প্রথম কাজ হলো অনুপ্রেরণা দেয়া, মানুষকে বোঝানো যেনো ছাদটাকে খালি ফেলে না রেখে যে কোনো ধরণের বাগান করেন। ‘আমরা সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেই সবজি ও ফলের বাগান করায়।’ কী ধরণের টবে, কেমন আয়োজনে করবে বা ছাদটি কেমন বাগানের জন্য বেশি উপযোগী – এসব পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন তারা।
ছাদকৃষি উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান এখন মনেপ্রাণে কৃষিকে লালন করেন। তার ভাষায় গাছও তাকে ভালবাসার ছোয়ায় সব কথা বলে দেয়। অবসর জীবনে এ এক অদ্ভুত সঙ্গ। যা জীবনকে সজিব ও প্রাণবন্ত রাখতে পারে।
বর্তমানে অনেকেই নিকটতম নার্সারিতে যোগাযোগ করে চারা, টব ইত্যাদি কিনে স্থাপন করছেন বাসার ছাদ ও বারান্দায়। নার্সারি বাণিজ্যেরও কিছুটা প্রসার ঘটছে। এক্ষেত্রে নার্সারি মালিকসহ ছাদ কৃষির উপকরণ বিক্রেতাদেরকে অবশ্যই ফল, সবজি ও ফুলের চারার সুস্থতার দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
একইভাবে প্রতিটি ফল, ফুল ও সবজির জাত, গুণাগুণ এবং পরিচর্যা কৌশল সম্পর্কে নিজে ভালোভাবে জেনে অন্যকে ধারণা দিতে হবে। কারণ, সঠিক তথ্যের অভাবে ছোট পরিসরে ছাদকৃষির উদ্যোগ নিয়ে বিফল হওয়ার আশংকা থেকে যায়। তাই ছাদ কৃষি সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা অনেক বেশি জরুরি।