২০১১ সালের ১৩ আগস্ট। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনির। সেদিন ঘটনার পর তারেক মাসুদের বাসার অবস্থা কেমন হয়েছিল? তা নিয়ে পরদিন প্রথম আলো প্রত্রিকায় একটি লেখা প্রকাশিত হয়। পাঠক, আসুন আজ আবার আমরা ফিরে যাই সেই দিনটিতে। অনুভব করি, সেই মুহুর্তগুলো। শ্রদ্ধা জানাই তারেক মাসুদকে—
কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার সময় বিমান থেকে নেমেই মুঠোফোন বার্তা পাঠিয়েছিলেন তারেক মাসুদ: ‘পরাটা আর খাসির মাংস খেতে চাই।’
তারেক মাসুদের দারুণ পছন্দ ছিল তাঁর বাসার বাবুর্চি জিয়ার হাতের রান্না খাসির মাংস। এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন জিয়া।
১৩ আগস্টও মানিকগঞ্জ থেকে রওনা হওয়ার আগে ফোন করেছিলেন জিয়াকে। দিনের খাবারের মেন্যু বলে দিয়েছেন।
‘রওনা হয়ে গেছি। কাজ শেষ। সঙ্গে মেহমানও আছেন। চার-পাঁচজন। বুঝতে পারছ? একটু ভালো করে রান্না কোরো। মাছ রাখবে।’—এ ছিল বাসার সঙ্গে তারেকের শেষ কথা।
তার কিছুক্ষণ পরই সব শেষ। একটি ভয়ানক ফোন বাসার সব কাজ থামিয়ে দেয়। মণিপুরীপাড়ায় তারেক মাসুদের বাসায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় বাড়তে থাকে। আত্মীয়স্বজন আর গণমাধ্যমকর্মীরা আসতে শুরু করেন।
সবার তখন একটাই প্রশ্ন—ক্যাথরিন মাসুদ কেমন আছেন?
বাসার শোবার ঘরের বিছানায় তখন খেলা করছিল নিষাদ; তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের ছেলে। বয়স এক বছর তিন মাস। ওর সঙ্গে ছিল ছোট দুই চাচার মেয়ে—তন্ত্রী আর অবন্তী। ওরা নিষাদেরই সমবয়সী। ওদের দুজনের হাত থেকে খেলনা কেড়ে নিয়ে খিলখিল করে হাসছিল নিষাদ। বসার ঘর ও খাবার ঘরের আত্মীয়স্বজনের কান্না তখনো তার কানে এসে পৌঁছায়নি। কারণ শোবার ঘরের দরজাটা ছিল ভেতর থেকে বন্ধ।
গৃহকর্মী পলাশী এই বাসায় এসেছেন বছর পাঁচেক হলো। নিষাদের দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব তাঁর। গতকাল সকাল পৌনে সাতটায় বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নিষাদকে আদর করতে ভোলেননি তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ। পলাশীর কোলে নিষাদকে দিয়ে ক্যাথরিন বলেছিলেন, ‘ওর দিকে খেয়াল রেখো।’
শোবার ঘরের এক পাশের দেয়ালে ‘মাটির ময়না’ ছবির শুটিংয়ের সময় তোলা তিনটি ছবি। অন্য পাশে রয়েছে বই আর তার বিভিন্ন বেটাকম ক্যাসেট, ডিজিটাল অডিও টেপ ও মিনি ডিভি টেপ।
‘মাটির ময়না’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বাবলু। এর পর থেকে আছেন তারেক মাসুদের বাড়িতেই। বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের সর্বশেষ খবর জানার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন বাসায় আসা আত্মীয়স্বজন আর গণমাধ্যমকর্মীরা।
বাবলু বললেন, ‘পৌনে ৭টার দিকে তারেক স্যার তাঁর নিজের গাড়িতে মানিকগঞ্জ রওনা দেন। আমারও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু গাড়িতে আর জায়গা ছিল না। আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আগে স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি বাসায় যাও।’
বসার ঘরে চিৎকার করে কাঁদছিলেন হাবিবুর রহমান, তারেক মাসুদের ছোট ভাই। বারবার বলছিলেন, ‘এ রকম বড় ভাই আর হবে না।’
বাসায় ক্রমেই ভিড় বাড়ছে। নিষাদকে তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন পলাশী। নিষাদ তখনো খিলখিল করে হাসছে। একটি দুর্ঘটনা যে ওকে পিতৃহারা করে দিল, সেটা বোঝার বয়স হয়নি ওর।
কোথায় যাচ্ছেন? পলাশী বলল, ‘দিনা আপা গাড়ি পাঠিয়েছেন। নিষাদকে নিয়ে এখনই ওনাদের বাসায় চলে যেতে বলেছেন।’
নিষাদের খাবার আর কাপড় ব্যাগে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়েন পলাশী। পেছনের দেয়ালে ঝুলছে তারেক মাসুদের হাসিমুখের ছবি।
এ বাড়িতে আর ফিরবেন না তারেক মাসুদ। হাসিমুখের ছবিটি থাকবে, থাকবেন না তারেক মাসুদ।