চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান আর খুনীরা পগারপার

৭ নভেম্বরকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। এবার সেই দিবস উপলক্ষে ৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী  উদ্যানে জনসভা করতে চায় বিএনপি। জনসভা নিয়ে সরাসরি বিরোধিতা না থাকলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৭ নভেম্বরকে বিপ্লব দিবস বলতে নারাজ। ১৯৭৫ সালের পর থেকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সরকারের সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালিত হলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করে দেয়। এতে বোঝা যায় ১৯৭৫ সালের নভেম্বর বিতর্কের অবসান হয়নি। আর এ কারণেই ৪১ বছর পরও আলোচনার সুযোগ আছে । এখনো ৭ নভেম্বরের পক্ষ-বিপক্ষের বিভাজনটা দারুণভাবে আমাদের জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে।

ডিবিসি নিউজে তাই আমাদের আট পর্বের আলোচনায় এ কথাটি বারবার ঘুরেফিরেই আসে যে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা যেমন, তেমনি নভেম্বরের ঘটনাবলীর পেছনেও আছে দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র। আর এটাও বলা যায় আগস্টের পর অনেকেই অপেক্ষা করেছে মূলত দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কী প্রতিরোধ হয় তা দেখার জন্য। কিন্তু আগস্ট-সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরের শেষে নানান পক্ষ আবারো সক্রিয় হয় । এর মধ্যে প্রথমটি ছিল সেনাবাহিনীর ভেতর থেকেই। সেটা ২/৩ নভেম্বর মিলে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানটি ‘ভারতীয় বা ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ বলে যে অভিধা পেয়েছে তার পেছনেও অনেকেই সক্রিয় ছিল।

মহিউদ্দিন আহমেদ তার “জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়’ বইতে লিখেছেন: ৪ নভেম্বর ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যেগে একটি শোক মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবের বাসভবনে যায়। মিছিলে খালেদ মোশাররফের ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ এবং তার মা অংশ নিয়েছিলেন। শহরে রটে যায় ‘আওয়ামী লীগ-বাকশালীদের’ পক্ষে অভ্যুত্থান হয়েছে। ৪ তারিখেই জানা যায়, আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছে। খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে দেনদরবার করছেন তাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দেওয়ার জন্য। ৪ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক তাকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন।

leader

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এসেছিলেন ডিবিসি নিউজের ‘উপসংহার’-এ। তার বক্তব্য: আওয়ামী লীগ তখন মাঠে নামলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেও ফারুক-রশীদ কিছুই করতে পারতো না। তিনি বলেছেন, ‘আমরাতো তখন ছিলাম, ইউনিভার্সিটিতে আসার কথা ছিলো বঙ্গবন্ধুর। আমরা সেখান থেকে নির্দেশ দিলাম, জমায়েত হওয়ার, বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত নিলাম। রেডিও থেকে জানলাম যে, শুধুমাত্র খন্দকার মোশতাক না বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সবাই একে একে দায়িত্ব গ্রহণ করলো মাত্র ৫ জন ছাড়া। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যেই কথা হলো, বঙ্গবন্ধুকে তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না সেজন্য তারা মর্মাহত।’

৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর ৪ নভেম্বর মিছিলের কথা উল্লেখ করে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, তার সাথে খালেদ মোশাররফেরও কথা হয়েছিল টেলিফোনে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘ফোনে আমি খালেদ মোশাররফকে বললাম আমরা মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবনে গিযে ফুল দেবো। আপনার লোকেরা যেন আমাদের বাধা না দেয়। হেসে দিয়ে তিনি ইংরেজিতে বললেন, এটা সিভিলিয়ান ব্যাপার, আর্মির কিছু করার নাই। আমি তখন সাহস পেয়ে আবার বললাম, আপনিও আসুন আমাদের মিছিলে। খালেদ আবার হাসলেন, বললেন আমার মা যাবেন।’

তার বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয় যে ওই মিছিল সম্পর্কে জানতেন খালেদ মোশাররফ। কিন্তু সেনানিবাসের একটি অভ্যুত্থানের সমর্থনে একটি মিছিল হলে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, সে সম্পর্কে তিনি ভাবতে পারেননি। অথবা হতে পারে যে, তার পক্ষে যে সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে, সেটাও তিনি জানান দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন বলাই যায় যে, মিছিলটি সেনানিবাসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হতে সাহায্য করেছিল।

মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন: ৩ নভেম্বর থেকে সেনানিবাসগুলোতে খালেদকে ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে যারা প্রচার করেছিলেন, তারা জিয়ার পক্ষের লোক। তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কর্নেল তাহের। সব জায়গায় রটে যায় ভারতের মদদে খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন।’ আলোচনায় দেখা যায় খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে তখন বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাক ও খুনী ফারুক চক্র আর সেনানিবাসে জিয়াউর রহমান বন্দী থাকলেও তার অনুসারীরা সক্রিয় ছিল। আর সেনানিবাসের ভেতরে বাইরে সক্রিয় ছিল জাসদ গণবাহিনী এবং তাদের সৈনিক সংস্থা।

khaled

সেনাবাহিনীর সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নেতৃত্বে থাকলেও ৩ নভেম্বরের “অপারেশন প্যান্থার” এর মূল পরিকল্পনায় ছিলেন কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল। নিজের লেখা ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইতে তিনি লিখেছেন, ‘পরিকল্পনামতো রাত তিনটায় বঙ্গভবনে মোতায়েন প্রথম বেঙ্গলের কোম্পানি দুটো ক্যান্টনমেন্টে চলে এলো। আমার স্টাফবৃন্দ- মেজর নাসির, মেজর ইকবাল, মেজর মাহমুদ এবং এমপি অফিসার মেজর আমিন অভ্যুত্থান শুরুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেনাপ্রধান জিয়াকে ১৫ আগস্টের খুনি বিদ্রোহকারীদের কবল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহর নেতৃত্বে প্রথম বেঙ্গলের এক প্লাটুন সেনা পাঠানো হলো তাকে নিরাপত্তামুলক হেফাজতে নেয়ার জন্য ‘তিনি আরো লিখেছেন, ‘৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী একজন হলেন রক্ষীবাহিনী থেকে সদ্য রুপান্তরিত একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আব্দুল গাফফার হালদার।’

৩ নভেম্বর একদিকে যখন সেনানিবাসে অভ্যুত্থান করে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হচ্ছিল, তখন সেই রাতেই অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ও ফারুক চক্রের নির্দেশে একদল সেনাসদস্য রাতেই জেলখানায় ঢুকে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে। ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী মেজর নাসির জানিয়েছেন যে ৪ নভেম্বর পুলিশের ডিআইজি ই এ চৌধুরী তাকে জেল হত্যার বিষয়টি জানান। এ খবর জানার পরও খালেদ মোশাররফ কেন ফারুক-রশীদ চক্রকে দেশত্যাগের ব্যাপারে সম্মত হলেন তা এখনো বড় রহস্য।

৪ নভেম্বর রাতে দুটি আদেশ জারী হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হলো খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে। অপরটি ছিল জেলহত্যার বিষয়ে একটি কমিশন গঠন। জেলখানার ভেতরে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন গঠনের আদেশে বলা হয় “লক্ষ্য করা গিয়াছে যে, জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সংগঠিত জঘন্য অপরাধমূলক কার্যকলাপের সহিত বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জড়িত রহিয়াছে বলিয়া কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল গুজব রটাইয়া বেড়াইতেছে। এই অপরাধমূলক কার্যকলাপের সহিত সেনাবাহিনী যে কোনক্রমেই জড়িত ছিলো না, সে কথা জনসাধারণকে পরিষ্কারভাবে বুঝাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। অনতিবিলম্বে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য প্রেসিডেন্ট ৩ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করিয়াছেন। এই কমিশনের প্রধান হইবেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক (আপিল বিভাগ) বিচারপতি জনাব আহসান উদ্দিন চৌধুরী এবং অপর দুই সদস্য থাকিবেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি জনাব কে এম সোবহান ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।” কিন্ত এই কমিশন কোনো কাজ করেনি বা করতে দেওয়া হয়নি। পরে এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা নেয়ার পর আহসান উদ্দিন চৌধুরী দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ৭৫ এর আগস্ট-নভেম্বরে এইচ এম এরশাদ ভারতে প্রশিক্ষণে ছিলেন । ওইসময় তিনি একবার ঢাকায়ও এসেছিলেন। (চলবে…)

(৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে গত অক্টোবর মাস জুড়ে ‘ডিবিসি’ টেলিভিশনে আট পর্বে  ‘উপসংহার’ নামে একটি টক-শো করেছেন ডিবিসি নিউজের এডিটর প্রণব সাহা। সেই টক-শোতে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং অন্যান্য বই ও দলিলপত্র ঘেঁটে তিনি চ্যানেল আই অনলাইন’র জন্য এ ধারাবাহিকটি লিখছেন। টক-শো’র মতো এখানেও তিনি সবার চোখ দিয়ে ৭৫’র নভেম্বরের ঘটনাগুলোতে দৃষ্টিপাত করে একটি উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন।)