নবম সংসদে এক অনির্ধারিত আলোচনায় বিএনপি নেতা এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছিলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর’। জবাবে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রসিকতা করে বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, কে কখন কী স্পর্শ করলে কাতর হয়, তা বোঝা মুশকিল।’
ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টাও এখন সেই অবস্থায় চলে গেছে। কার ধর্মের অনুভূতি কখন যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তা বোঝা মুশকিল। আবার ধর্মকর্মের ধারেকাছে না থাকলেও তথাকথিত ওই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের গুজব শুনেই লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার লোকের সংখ্যাও কম নয়। শুধু প্রতিক্রিয়াশীল বলে পরিচিতরাই নয়, তথাকথিত মুক্তচিন্তা আর গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলোও এই ‘ধর্মরক্ষার যুদ্ধে’ শামিল; যার সবশেষ উদাহরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
জেলার নাসিরনগর উপজেলায় গত ৩০ অক্টোবর প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালানো হয় মন্দিরে। ভাংচুর করা হয় মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে। চলে লুটপাট। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন সেই হামলা ও ভাংচুরের ছবি মানুষের হাতে হাতে। দেখানো হয়েছে টেলিভিশনের সংবাদে। পুলিশ বলছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানে ওই ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হয়েছে। যদিও এই অভিযাগ নাকচ করে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রতিটি ঘটনার পরে এরকম অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ আর অভিযোগ খণ্ডন নতুন কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবতা বড় নির্মম। এখন কোনো ঘটনাই আর ব্ল্যাকআউট করার সুযোগ নেই। সব ঘটনাই ধরা পড়ছে কারো না কারো ক্যামেরায়; যা ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অর্থাৎ অপরাধের এই ভিডিওচিত্রই এখন সত্য গোপনের বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমরা যে নির্মম বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তা হলো-আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি ‘অতিমাত্রায় প্রখর’। আমরা ধর্মকর্মের চর্চা না করলেও, দিনে একশো মিথ্যা কথা বললেও, প্রতিনিয়ত প্রতারণা আর ভণ্ডামির সাথে বসবাস করলেও, মানুষ ঠকালেও আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি ‘অত্যন্ত জোরালো’। আমরা যখনই শুনতে পাই কোথাও কেউ এই তথাকথিত ধর্মীয় অনভূতিতে আঘাত দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আমরা বেরিয়ে পড়ি লাঠিসোটা নিয়ে। আর ঘরপোড়ার মধ্যে আলুপোড়া দেয়ার লোকেরও যেহেতু অভাব নেই, সুতরাং যখন একটি পক্ষ মন্দিরে হামলা ও ভাংচুর চালায়, তখন ওই সুযোগসন্ধানী পক্ষ শুরু করে লুটপাট। আমরা ধর্মের অনুভূতি রক্ষা করতে গিয়ে আরেকজনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দিই। আমরা আল্লাহ-রাসুলের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে গিয়ে অন্য ধর্মের দেবতাদের চূর্ণবিচুর্ণ করি।
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মর্যাদা এত ঠুনকো নয় যে, কোথাকার কে একজন ফেসবুকে কী লিখলো আর তাতেই আল্লাহ রাসুলের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়ে গেলো। যিনি লিখেছেন বা আপত্তিকর ছবি দিয়েছেন, যদি সেটি প্রচলিত আইনে অপরাধ হয়, তাহলে সেই আইনেই তাকে গ্রেপ্তার এবং তার বিচারের জন্য আদালত রয়েছেন। ধর্মীয় অনুভূতি যাদের প্রবল, যারা মনে করেন ফেসবুকে কিছু একটা লিখলেই তাদের ধর্মের অবমাননা হয়ে গেলো, তারাও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু সেটি না করে তারা লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একটি অন্যায় দমন করতে তারা আরও পাঁচটি অন্যায় করেন।
প্রত্যেকেরই কোনও না কোনও ধর্ম বা বিশ্বাসের প্রতি আস্থা থাকতে পারে এবং এটি প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়। তাই কেউ যদি তার ওই অনুভূতিতে আঘাত দেন তখন আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির সংক্ষুব্ধ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রতিক্রিয়া তিনি কীভাবে ব্যক্ত করবেন, তা নির্ভর করে কোন ধরনের সমাজে আমরা বাস করছি তার ওপর।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার রায় ঘোষণার সময় এর পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছিলেন, ‘শুনেছি ব্লগাররাও এমন কিছু লেখেন, যা পড়লে নাকি মারতে ইচ্ছে করে। আসলে আমরা সবাই ধৈর্যহারা হয়ে গেছি। সকলকেই ধৈর্য ধরতে হবে। আইন হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।’ বিচারকের প্রশ্ন,‘কেউ কিছু লিখলেই তাকে মেরে ফেলতে হবে?’
বিচারকের এই প্রশ্ন আমাদেরও। ধরা যাক কেউ একজন তার জ্ঞানের অভাবে অথবা সচেতনভাবেই সৃষ্টিকর্তা, বা কোনো ধর্ম অথবা সেই ধর্মের অবতারকে নিয়ে আপত্তিকর কিছু লিখলেন। তার অর্থ এই নয় যে, একজন ব্যক্তির ওই অপরাধের কারণে তার পুরো কমিউনিটির উপরে কিংবা তিনি যে ধর্মে বিশ্বাস করেন, সেই ধর্মের উপাসনালয়ে গিয়ে হামলা চালাতে হবে। একজন ব্যক্তির অপরাধ একটি জনগোষ্ঠী কেন নেবে? ব্যক্তির অপরাধের জন্য প্রচলিত আইন রয়েছে। বিচারব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমরা অনেক সময়ই অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য এমন সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিই, যা সমাজে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরির মতো পরিস্থিতি তৈরি করে।
আমাদের জানা দরকার, মহানবী এবং কোরআনের মর্যাদা রক্ষার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। কেউ যদি আল্লাহ, মহানবী বা কোরআনকে সত্যি সত্যিই অবমাননা করেন, তার জন্য প্রচলিত আইন তো বটেই, যারা পরকালে বিশ্বাস করেন তারাও জানেন, এর শাস্তি তাকে পরকালেও পেতে হবে।
সুতরাং যারা প্রচলিত আইন এবং আল্লাহর শাস্তির প্রতিশ্রুতিতে আস্থা না রেখে নিজেরাই বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন-তাদের আসল উদ্দেশ্য ধর্মরক্ষা নাকি অন্যকিছু, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)