হাজার শ্রমিককে লাশ বানানো রানা প্লাজা ভেঙ্গে পড়ার মূল কারণ নির্মাণ ত্রুটি, কর্তৃপক্ষের অবহেলা। বিপুল প্রাণহানীর অন্যতম কারণ বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপ। রানা প্লাজা ধসের পেছনে চারটি নির্মাণ ত্রুটি সরাসরি কাজ করেছে। কোনোরকম নিয়ম-নীতি না মেনে পুকুরের ওপর ভবন নির্মাণ, বাণিজ্যিক ভবনকে শিল্পকারখানায় রূপান্তর, অবৈধভাবে অতিরিক্ত চারতলা নির্মাণ এবং নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর কারণেই ধসে পড়ে রানা প্লাজা। নিম্নমানের রড-সিমেন্টের নড়বড়ে কাঠামোতে পোশাক কারখানাগুলোর ভারী জেনারেটরের কম্পন ধীরে ধীরে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছিলো রানা প্লাজাকে ।
এই ত্রুটিগুলো একদিকে যেমন ভবন মালিক সোহেল রানার অর্থ লোলুপ অসাধু ব্যবসার দৃষ্টান্ত তেমনি সাভারের প্রশাসনিক ব্যর্থতার নিকৃষ্ট উদাহরণ।
দুর্বৃত্তির সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি উন্মোচিত হয় রানা প্লাজায় ফাঁটল দেখা দেয়ার পর। ভবনে ফাটল দেখা দেয়ার পর বিশেষজ্ঞদের পরিদর্শনের আগ পর্যন্ত রানা প্লাজা খালি করে দিতে বলেছিলো শিল্প পুলিশ।
অথচ এই নির্দেশনা পাশ কাটিয়ে বিদেশী ক্রেতাদের খুশি করতে মরিয়া ছিলো রানা প্লাজার হর্তাকর্তারা। ধসে পড়ার আগের দিন ভবনে ফাটল দেখতে পায় কর্মরত পোশাক শ্রমিকরা। ফাটল দেখে আতঙ্কিত শ্রমিকদের কথায় কান দেয়নি রানা প্লাজার মালিকপক্ষ। উল্টো গণমাধ্যমের সামনে ভবন মালিক সোহেল রানা ফাটল দেখা যাওয়াকে ‘গুরুতর কিছু না’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
কারখানা মালিকদের বোঝানো হয় ভবনে তেমন কিছুই হয়নি। এজন্য পোশাক কারখানাগুলোর ব্যবস্থাপকরা শ্রমিকদের ‘টালবাহানা’ না করে কাজে আসার নির্দেশ দেয়।
সবচেয়ে নৃশংস কাজটি করা হয়েছিলো ২৪ এপ্রিল, রানা প্লাজা ধসের দিন সকালে। এক মাসের বেতন কেটে নেয়া হবে এমন হুমকিতে ফাটল ধরা সেই মৃত্যুকূপে কাজে যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো পোশাক শ্রমিকদের।
পোশাক কারখানাগুলো কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তা নিয়ে যথেষ্ট তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। অনেকেই মনে করেন সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতেই রানা প্লাজায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কারখানা মালিকরা। এজন্য ঠিক প্রত্যক্ষভাবে না হলেও বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো রানা প্লাজায় ব্যাপক প্রাণহানীর দায় এড়াতে পারে না ।
গার্মেন্টস জগতের রমরমা ব্যবসায় তথাকথিত ‘ফাস্ট ফ্যাশন’-এর জন্য সবসময়ই মালিক পক্ষের একটা তাড়া থাকে। কেউ কেউ মনে করেন বিদেশী ক্রেতাদের এই ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ চাহিদা এবং কম মজুরিতে কাজ করিয়ে নেয়ার প্রবণতায় শ্রমিক স্বার্থের বিষয়টি একেবারেই প্রাধান্য পায়নি। এমনকি যাদের শ্রমিক স্বার্থ দেখার কথা সেই ট্রেড ইউনিয়নও মালিকপক্ষের চাপের কাছে মাথানত করেছিলো।
এই ট্রেড ইউনিয়ন নিয়েও আছে বিতর্ক। অনেকেই মনে করেন সত্যিকার অর্থে ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে শ্রমিকপ্রতি উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে বিদেশী ক্রেতারা আরও সস্তা কোনো বিকল্প দেখবে এমন ধারণাও করে কেউ কেউ।