আগামী ১৯ এপ্রিল নিউইয়র্ক রাজ্যের প্রাইমারীকে সামনে রেখে ইচ্ছে হলো স্থানীয় নির্বাচন অফিসে খোঁজ নেই, দেখি ভোটার তালিকায় নাম আছে কি-না। টেলিফোন করার সঙ্গে সঙ্গে অপর প্রান্ত থেকে মহিলা কর্মকর্তা জানালেন, তালিকায় আমার এবং অর্ধাঙ্গীর নাম আছে ঠিকই কিন্তু এ যাত্রায় প্রাইমারীতে আমরা ভোট দিতে পারব না।
কেন? কারণ- আমি স্বেচ্ছায় তালিকাভূক্ত হয়েছিলাম স্বতন্ত্র হিসেবে, আর অর্ধাঙ্গী হয়েছিলেন গ্রীণ পার্টির সদস্য হিসেবে। কর্মকর্তা বললেন- নভেম্বরের নির্বাচনের পর তোমরা পছন্দের দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুনভাবে তালিকাভূক্ত হতে পারো।
আমার ইচ্ছা প্রাইমারীতে যেন যে করেই হউক বার্নি স্যান্ডার্সই জেতেন। সেদিন এক ইতালিয়ান যুবক লুকা’র সঙ্গে রাজনীতি ও বিশ্ব পরিসর নিয়ে বিস্তর আলোচনা। সে ইতালিয়ান নাগরিক, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে বিখ্যাত ইতালিয়ান মদ লিকারের ব্যবসা করতে। নিউজার্সিতে অফিস কাম রেসিডেন্স। উড়োজাহাজে সারা আমেরিকা চসে বেড়ায়। জানালো ইতালিয়ান কোম্পানির তিন মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা দেখভাল করে সে। কিন্তু বেতন যা পায়, তা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে দুই সপ্তার বেশি দিন গোজরান করা সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে অফিস-কাম রেসিডেন্স, এবং অফিসের খরচেই ভ্রমণ-ভাত!
লুকা’র কথা এখানে উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, তাকে প্রশ্ন করেছিলাম- এই যে আইসিস ক্রাইসিস, মধ্যপ্রাচ্যের ধ্বংসযজ্ঞ, এটাকে তুমি কিভাবে দেখ? উত্তরে সে জানালো- দেখ আইসিস তো সৃষ্টি করেছে পশ্চিমী দুনিয়া নিজেদের স্বার্থে। বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক আক্রমণকে ঢেকে দিতে তারা আইসিস সৃষ্টি করেছে। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে তুমি যে ধর্মীয় উন্মাদনা দেখছো এটা হলো ইরাক আক্রমণের পরিণতি। এখন মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের মাথায় কুড়াল মারছে, পশ্চিমী দুনিয়ার নাগরিকরা এই সরল সমীকরণ ঠিকই বুঝে।
সে পাল্টা প্রশ্ন করল- তোমাদের দেশেও তো একই সমস্যা। এ ব্যাপারে তোমার চিন্তা ভাবনা কি? আমি উত্তর দিলাম- মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যা চলছে, তার ছিটেফোটা তো আমাদের ওখানে হবেই। কারণ গত কয়েক হাজার বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক বন্ধন। ওখানে আগুন লাগলে আমাদের শরীরে আঁচ তো লাগবেই!
বিজ্ঞ লুকা আমাকে জিজ্ঞেস করল নির্বাচন নিয়ে তুমি কি ভাবছো? বললাম- আমি বার্নি স্যান্ডার্সের পক্ষে। বার্নি স্যান্ডার্স জিতে আসুক নভেম্বরের নির্বাচনে তাই কামনা করি। বার্নি স্যান্ডার্স জিতলে আমেরিকার ভাল হবে, কিন্তু ট্রাম জিতলে আমেরিকার সর্বাধিক ক্ষতি হয়ে যাবে! লুকা আমাকে বলে- তুমি যাই বল, আমেরিকা এখনো বার্নি স্যান্ডার্সের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য তৈরি না।
আমি তখন তাকে বললাম- তোমার বয়স তো আমার চেয়ে কম। তুমি কিভাবে এতোটা ‘পেসিমিস্ট’? পরিস্থিতি তো তৈরি করব আমরা কিংবা আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম। আমরাই যদি এতোটা নেতিবাচক হই, তাহলে আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম কিভাবে সময়টাকে পাল্টাবে? লুকা এবার আমায় দাওয়াত দিল, বলল- কাল আমি চলে যাচ্ছি ইতালি। ফিরে এসে তোমাকে কল দেব। অনেক কথা আছে।
শুক্রবার মসজিদে গেলাম। দেখলাম- বার্নি স্যান্ডার্সের পক্ষে একটি প্রচারপত্র। তার শিরোনাম- “মুসলিম ডেমোক্রেটরা বার্নি স্যান্ডার্সকে ভোট দেবে কেন?” বার্নি স্যান্ডার্সের পক্ষে দশটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
(১) হিলারী ক্লিনটন বা অন্যান্য রিপাবলিকান প্রার্থীর মতো প্রো-ইসরাইলী কিংবা এন্টি প্যালেস্টাইনী নন প্রথম ইহুদী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স ।
(২) বার্নি স্যান্ডার্সকে অনুমোদন দিয়েছেন মিনেসোটার প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিম কংগ্রেসম্যান কীথ এলিসন।
(৩) ২০০৩ সালে বার্নি স্যান্ডার্স ইরাক যুদ্ধের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। হিলারী এই যুদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, যার পরিণতিতে রক্তাক্ত যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে, শুধু তাই নয় একই যুদ্ধের পরিণতিতে আক্রান্ত হয় লিবিয়া!
(৪) বার্নি স্যান্ডার্স যুক্তরাষ্ট্রের পেট্রিয়ট আইনের বিরুদ্ধেও ভোট দিয়েছেন। যে আইনের কারণে দেশে মানুষের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে।
(৫) বার্নি স্যান্ডার্স ভোট দিয়েছিলেন ‘নাফটা’ চুক্তির বিরুদ্ধে। হিলারি দিয়েছিলেন এর পক্ষে। যে চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ চাকুরি চলে গেছে দেশের বাইরে।
(৬) বার্নি স্যান্ডার্স ইউনিভার্সেল হ্যালথ কেয়ারের পক্ষে। এখনও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন কোটি বীমাহীন লোককে স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আনাই তার লক্ষ্য। এ ব্যাপারে হিলারির কোনো পরিকল্পনা নেই।
(৭) বার্নি স্যান্ডার্স যুক্তরাষ্ট্রের সন্তানদের জন্য “ফ্রি কলেজ টিউশন” এর পক্ষে। বলে রাখা ভাল- যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্রদের শিক্ষা ঋণ প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার। এবং অধিকাংশ ছাত্র ভাল বেতনের চাকরির অভাবে শিক্ষা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ। অর্থনীতির জন্য এটি এখন অশনি সঙ্কেত।
(৮) নিম্নতম মজুরি ঘন্টায় ১৫ ডলার করার পক্ষে বার্নি স্যান্ডার্স।
(৯) অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া (ক্রিমিন্যাল জাস্টিস সিস্টেম) সংস্কার করবেন বার্নি স্যান্ডার্স।
(১০) বার্নি স্যান্ডার্স পরিবেশবাদীদের পক্ষে।
এছাড়াও বার্নি স্যান্ডার্স যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সব সামরিক বেইস তুলে আনার পক্ষে। এতে করে সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ভূমিকার অবসান যেমন ঘটবে, তেমনি কোটি কোটি ডলার সাশ্রয় হবে।
বার্নি স্যান্ডার্স যে প্র-ইসরাইলী নন, তার প্রমাণ সম্প্রতি ইসরাইলী প্রভাবশালী গোষ্ঠী এইপেক ( আমেরিকান ইসরাইলী পাবলিক এফেয়ার্স কাউন্সিল, AIPAC) এর অনুরোধ সত্ত্বেও তাদের সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে যাননি। ভারমন্টের ৭৪ বয়স্ক সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের জন্ম ব্রুকলিনে। তার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন পোলান্ড থেকে ১৯২১ সালে। তার বাবা ইলিয়াস স্যান্ডার্স, তাদের পরিবারে খাবারের অভাব ছিল না তবে প্রাচুর্যের অভাব ছিল। স্যান্ডার্স বলেছেন রাজনীতিতে তার আগ্রহ ছিল ছোটকাল থেকে। তিনি বলেন- নির্বাচন কতটা গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৯৩২ সালে হিটলার নির্বাচিত হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যার মধ্যে ৬০ লাখ ইহুদীও ছিল।
“A guy named Adolf Hitler won an election in 1932. He won an election, and 50 million people died as a result of that election in World War II, including 6 million Jews. So what I learned as a little kid is that politics is, in fact, very important.”
স্যান্ডার্স সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন সাংবাদিক হ্যারি জেফ। তাতে তিনি বলেন-
“Barney gave hope and an opportunity to American people to change the country’s course; from exclusion to inclusion, from hoarding to sharing, from oligarchy back to democracy.”
উল্লেখ্য- প্রাইমারীতে ভোট দিতে না পারলেও প্রাইমারী উতরালে আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে বার্নি স্যান্ডার্সকে আমি ভোট দেব ঠিকই। পরিবর্তনের আশায় ভোট দিয়েছিলাম ওবামাকে। কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি, তাতে কী? আশা’কে মারতে নেই!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)