কম্পিউটারের পর্দায় অসংখ্য ছবির মধ্যেই ডুবে ছিলেন কফিল উদ্দিন পারভেজ। হঠাৎ একটা ছবিকে ক্লোজআপে সামনে এনে জানতে চান- দেখেন তো এদের চিনতে পারেন কী না। অনেক আগের শাদা কালো ছবিটা। নতুন বিয়ের বর কনে, পাশে অভিভাবকশ্রেণীর একজন ভদ্রলোক। কনেকে চিনতে সময় লাগলো না। শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। পাশে বর ওয়াজেদ মিয়া। তৃতীয় ছবিটি আমার কাছে অপরিচিত। ‘এম এ আজিজ, চট্টগ্রামের এক সময়কার আওয়ামী লীগ নেতা। এই বিয়ের আয়োজনে যার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো।’ – এইটুকু বলেই পারভেজ থামেন।
টরন্টোর বাংলা পাড়া হিসেবে খ্যাত ডেনফোর্থের ‘আইপি ওয়ার্ল্ডে’ কফিলউদ্দিন পারভেজের পাশে বসে অন্যান্য ছবিগুলোতেও চোখ রাখি। পারভেজ তার দাদা এম এ আজিজের স্মৃতিকে আগলে রেখেছেন পরম মমতায়।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক নিরব ঘটনাক্রমেরই যেন সাক্ষী এই ছবিগুলো। আর হবে না কেনো। এম এ আজিজ নিজেই তো ইতিহাসের অংশ, মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার, বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের জন্মের ইতিহাসের অংশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এম এ আজিজ নিজেও যেনো একটা ইতিহাস।
কেন্দ্রভিত্তিক রাজনীতির গতানুগতিকতায় একটি বিভাগীয় শহরে অবস্থান করেও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে অপরিহার্য প্রভাব বিস্তারের ইতিহাস রচনা করেছিলেন এই এম এ আজিজ। স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে অগ্নিগর্ভ সময়টায় তিনি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন সাহসিকতার সাথে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস পাঠের পাশাপাশি স্বাধীনতাপূর্ব রাজনৈতিক গণআন্দোলনের পঠন-পাঠনে তাই এম এ আজিজও একটি অবশ্য পাঠ্য নাম হিসেবেই বিবেচিত। কিন্তু নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের এই বীর যোদ্ধারা তেমনভাবে আলোচিত হন না।
অথচ বাঙালির মুক্তি সনদ হিসেবে খ্যাত ৬ দফার সঙ্গে এম এ আজিজের ভূমিকাই তাকে ইতিহাসে চিরঞ্জীব করে রাখার কথা। ১৯৬৪ সালে লাহোরে বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা ঘোষণা করেন, তখন দলের ভেতরে-বাইরে প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখোমুখি হন তিনি। খোদ আওয়ামী লীগও তখন ৬ দফাকে ঠিক গ্রহণ করে নিতে পারছিলো না। ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধু পাশে এসে দাঁড়ান এম এ আজিজ। তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ৬ দফাকে সমর্থন করে পত্রিকায় বিবৃতি দেয়।
এখানেই থেমে থাকেননি এম এ আজিজ। ৬ দফাকে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্বও নেন। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে ৬ দফার সমর্থনে জনসভারও আয়োজন করেন তিনি। সেটিই ছিলো ৬ দফার সমর্থনে প্রথম প্রকাশ্য জনসভা। আর এ কারণে নিরাপত্তা আইনে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন আহমেদ, জহুর আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে তিনিও গ্রেফতার হন।
বঙ্গবন্ধুর সেই ৬ দফাই শেষ পর্যন্ত বাঙালির মুক্তির দলিল হিসেব স্বীকৃতি পায়। ছয়দফার পথ ধরেই এক দফার দিকে এগিয়ে যায় বাঙালি। কেন্দ্রের বাঘাবাঘা নেতারা সেদিন ৬ দফার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য অনুধাবন করতে না পারলেও চট্টগ্রামের নেতা এম এ আজিজ ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এই দূরদর্শিতাটুকু তিনি দেখাতে না পারলে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনকে হয়তো আরো চড়াই উৎরাই পার হতে হতো।
আর হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার সমর্থনে প্রকাশ্যে প্রথম মাঠে নামলেও এম এ আজিজ আসলে এক দফার বক্তৃতাই করতে শুরু করেছিলেন। ’৬৯-এর গোড়ার দিকে কক্সবাজার পাবলিক হলে আওয়ামী লীগের কর্মীসভায় তিনি প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘পাকিস্তানিরা ৬ দফা না মানলে ১ দফার আন্দোলন বেছে নিতে বাধ্য হবো।’ ’৭০-এর ১৫ মে লালদীঘি ময়দানে সৈয়দ নজরুল ইসলামের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের জনসভায় খোলামেলা ঘোষণা করেন, ৬ দফা গ্রহণ না করলে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাবে। তখন মাত্র ১ দফার আন্দোলনই শুরু করা হবে।
তথ্যপ্রবাহ বিশ্লেষণে দেখা যায়, এম এ আজিজ বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলনের সমর্থনে জনমত গঠনের দায়িত্ব নিলেও ‘এক দফার’ পক্ষেই বক্তব্য রাখতে শুরু করেছিলেন। তাকে এক দফার প্রবক্তা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা কেবল বন্ধুত্বেরই ছিলো না, আস্থারও ছিলো। ফলে এম এ আজিজ যখন জোরেসোরে এক দফার পক্ষে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করতে শুরু করেন, তখন অন্যদেরও বুঝতে অসুবিধা হয়নি, শেখ মুজিব আসলে এক দফার পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন সংগ্রামের একেবারে অপরিহার্য পরিপূরকই ছিলেন যেনো এম এ আজিজ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে এম এ আজিজের ভূমিকাও ছিলো স্মরণ করার মতো। তার নেতৃত্বেই সেই সময় বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে পালিত হয় ‘মুজিব দিবস’। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ব্যয় নির্বাহের জন্য তার উদ্যোগেই গঠিত হয় ‘মুজিব ফান্ড’। কুপন ছাপিয়ে সেই ফান্ডের জন্য অর্থও সংগ্রহ করা হয়।
চট্টগ্রামের গণঅভ্যুত্থানের নায়কও ছিলেন এম এ আজিজ। ১৯৭০ সালের ১৮ জুলাই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে তিনি পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতার হন। তার গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং ২৭ জুলাই আজিজ দিবস পালন করা হয়। সে বছরই ১৫ আগষ্ট তিনি মুক্তি পান। মুক্তি লাভের পর ঢাকায় ঢাকসু এবং ইউকসু তাকে সংবর্ধনা দেয়। ওই সংবর্ধনায় বক্তৃতাকালে এম এ আজিজ বলেন: ‘If you (Pakistani Junta) have got the right to exceed, we shall have the right to secede.’
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অপরিহার্য এই নেতা ১৯২১ সালে চট্টগ্রামের হালিশহরে জন্মগ্রহণ করেন। পাহাড়তলী রেলওয়ে হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করার পর পরই তিনি তৎকালীন মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে তিনি আইএ পাশ করেন।
স্নাতক শ্রেণীতে পড়ার সময়ই রাজনৈতিক কারণে তিনি কলেজ থেকে বহিষ্কার হন। পরে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে তরুণ নেতা ও সংগঠক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। রাজনীতির পরিক্রমায় তিনি মুসলিম লীগের প্রগতিশীল গ্রুপ হিসেবে পরিচিত আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপে যোগ দেন। কিন্তু প্রখর অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারনে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নে যোগ দেন নতুন এ দলে যা পরে হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু ওই পদেই বহাল ছিলেন।
১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি কোতোওয়ালি–ডবলমুরিং নির্বাচনী এলাকা থেকে এমএনএ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে এমএনএ হিসেবে শপথ নেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় চট্টগ্রামবাসী তার সম্মানে বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করে। সেই সংবর্ধনা সভায় এম এ আজিজ বলেছিলেন, ‘বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়যুক্ত হওয়ায় বিষয়টিকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে না দেখে সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য ‘গণম্যান্ডেট’ হিসেবে দেখতে হবে।’
বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাংলার আকাশে বাতাসে বারুদের গন্ধ পাচ্ছি, পশ্চিমারা ভুট্টোর পিপলস্ পার্টিকে ভোট দিয়ে একদিকে রায় দিয়েছে। আর বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরকে ভোট দিয়ে, আমাকে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে অন্যদিকে রায় দিয়েছে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে কার্যত আমরা আলাদা হয়ে গেছি। অতএব আমাদের মিলন অসম্ভব।’ এম এ আজিজের সেই ভবিষৎবাণীই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলন আর কোনোদিনই হয়ে ওঠেনি। এক দফার আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটেছে।
বাঙালির মুক্তি আর স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে গেলেও সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি এম এ আজিজ। স্বাধীনতা আন্দোলনের উন্মাতাল সময়ে ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি ফটিকছড়িতে জনসভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বাধীনতার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা, দূরদর্শী রাজনীতিক এম এ আজিজের মৃত্যুবার্ষিকী প্রতি বছরই অনেকটা নিরবে পার হয়ে যায়। অথচ ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলো নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা আমাদের ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করতো।
বীর প্রসূতি চট্টলা অসংখ্য বীরের জন্ম দিয়েছে। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের আরেক বীরপুরুষ এম এ আজিজ। রাজনীতির অবক্ষয়ের এই যুগে এম এ আজিজের মতো বিচক্ষণ রাজনীতিকদের জীবন সংগ্রামের আলেখ্য রাজনীতিকদের নতুন করে ভাবতে শেখাবে নিঃসন্দেহে। আর নতুন প্রজন্মের সামনে তার জীবনালেখ্য উন্মোচন করবে বাংলাদেশের জন্মের আন্দোলনের অনেক অজানা উপাখ্যান। এম এ আজিজের সংগ্রামময় জীবন নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)