কবিতার কি সীমানা আছে কোনো? অথবা ছাঁচে ফেলা ধরণ যেভাবে বলা যায় হ্যাঁ, এই যে এবার তবে হয়ে উঠলো একখানা কবিতা? কবিতার তো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। মোড়লের নিয়মে আবৃত হয়ে কবে আর কবিতা হয়ে উঠেছে কোনো একাগ্র কবিতা? সে নিজে যেমন মুক্ত, স্বাধীন তেমনি পাঠককেও সে নিয়ে চলে তার মুক্তপথে। কবিতা তো নিয়ে চলে কোথাও না কোথাও… কখনও ছন্দের মাধ্যমে, কখনও শব্দের মাধ্যমে দৃশ্যকল্প তৈরি করে কবিতা তার পাঠককে নিরন্তর বয়ে নিয়ে যায় অন্যকোথাও; বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা অথবা লুকিয়ে থাকা বোধের উদ্যানে। আর কবিতার হয়ে এই কাজটি করেন কবি।
নতুন ধরণে নতুন রূপে কবিতাকে সাজিয়ে সময়ের হাতে তুলে দেয়াই কবির কাজ আর কাব্য দেবীর রূপের এহেন পরিস্ফুটন ঘটে তরুণ কবির হাত ধরেই। পুরনো ধারাকে পরিমার্জিত, সংযোজন বা নব উন্মেষ ঘটে তরুণের হাত ধরেই আর এর পেছনে থাকে কবির নিরন্তন নিরীক্ষা আর অভিজ্ঞতা।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, বিশের দশক ছিল আধুনিক বাংলা কবিতার সংযোজনের দশক। যে দশকে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধিন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তীরা হাজির হন বাংলা কবিতার ছন্দে এবং রূপে নতুন ধারা নিয়ে। বাংলা কবিতার পাঠক দেখতে পেলো রবিন্দ্রবলয়ের বাহিরেও উপভোগ্য কাব্যবলয় তৈরি করা সম্ভব; পৌঁছানো সম্ভব অনুভূতির ভিন্ন মাত্রায়। তাই জীবনানন্দ যখন লিখলেন- “অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে/সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;/আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,” এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয় না যে, এ ক্লান্ত প্রাণ আমি নই।
কবিতার নতুন রূপ নিয়ে এই পঞ্চপাণ্ডবের আবির্ভাব বিশের দশকে হলেও সার্বিক প্রকাশ ঘটে ত্রিশের দশকে বা আরও পরে। এর কারণ নতুন কিছুকে গ্রহণ করা বা জানার আসক্তি আমাদের পাঠকের কম। ষাট এবং সত্তরের সময়ের কবিতার যে রূপ তার চেয়ে ভিন্ন রূপে এসে পাই নব্বইয়ের কবিতাকে। অর্থাৎ কবিতা সময়ের সাথে সাথে তার রূপ, রং এবং ধরণ পরিবর্তন করতে করতে এসে এই সময়ে উপস্থিত হয়েছে আর কবিতার এই বিবর্তনের পেছনে বরাবরই রয়েছে কবি। জীবনের ক্ষরণকে সময়ের সীমানা থেকে তুলে নিয়ে যারা এঁকে গেছে মহাকালের চিত্র।
তেমনি এক কবি দ্রাবিড় সৈকত। কবি এবং চিত্রশিল্পী। আবির্ভূত হয়েছেন কবিতার সাম্রাজ্যে নতুন এক সংযোজন নিয়ে। কুত্রাপি ছন্দ নিয়ে। যদিও বাংলা কবিতার ছন্দকে মোটামুটি তিন ধরণের বলে ধরে নেয়া হয়- স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত। এর বাহিরে যত কবিতা লেখা হয় তার মানে কি তা ছন্দছাড়া? মোটেই না। ছন্দ মানে তো শুধু অন্তমিল নয়। ছন্দের কোন কাঠামোকে অনুসরণ না করেও কবিতাকে নির্মাণ করা যায় ছন্দশৈলী তে। শব্দ, দৃশ্য বা অনুভূতির প্রগাঢ় বন্ধনে নির্মিত কবিতা কখনও হয়ে উঠেনা ছন্দহীন। এই নতুন ছন্দের নামই কুত্রাপি। যার অর্থ ‘কোথাও’।
কুত্রাপি আমাদের ঠিকই কোথাও না কোথাও পৌঁছে দেয়। প্রাত্যহিক জীবনের আনন্দ বেদনার পাল্লায় যেমন কুত্রাপিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব তেমনি সম্ভব দূরের খোয়াবনামায় তাকিয়ে কার্পাস তুলোর মতন উড়ে চলে যেতে দেখা- পরিচিত হরপ্পা আর পান্ডুরাজার ঢিবি; যার বাঁকে বাঁকে সুরিয়ালিজমের আমেজ। আছে গভীর জীবনবোধ; কিছু ভীতি কিছু ক্লান্তি- “সমুদ্র সুবিশাল ভেসে আছি, দেশে যাই কোন নায়?/ বন্যায় ভেসে গেলে গড়াগড়ি করে কিছু রিলিফের মতো করে বেঁচে যাই।“
চরণের সাথে চরণের এমন শব্দে শব্দে মিলিয়ে দেয়া আছে যেমন তেমনি রয়েছে প্রকৃত গদ্যের চালচলন। তবু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের বন্ধন অটুট। হাসতে হাসতে তারা কখনও বাতাসে মিলিয়ে যেয়ে পরক্ষণেই যেন ধেয়ে আসছে ষোলকলা পূর্ণ করে- “উত্তম পুরুষে হাঁটি/অধম আদমের ছায়াতে/মায়াতে মনো বিকলন যতদিন দিয়েছে ডাক/তাক থেকে নামিয়েছি পুস্তক/রাগ রেখে কামিয়েছি মস্তক/ভরা চুল/কড়া গুল মেরে উল্টিয়ে দিয়েছো দ্বিধাদের সংহিতা ব্রাহ্মণ/ঝাঁক বেঁধে তাই লজ্জার খেয়েছি মাথা/করাতের ধর্ম বুঝেই বিছালাম শীতল পাটি”। কুত্রাপি ছন্দের মাধ্যমে কবি’র এই প্রচেষ্টা কখনও স্যটায়ারধর্মী, অন্তরাত্মা কাপিয়ে দেবার মতন রক্তচক্ষুর ধারক কখনোবা হয়ে উঠতে পারে মগজকে খুঁচিয়ে তোলার মতন গনগনে অগ্নিশলাকা।
কদাচিৎ কুত্রাপি(২০১৫) এবং বিকস্বর কুত্রাপি (২০১৮) নামে কুত্রাপি ছন্দে লিখিত কাব্যগ্রন্থে মোট প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা পাঁচশতেরও অধিক। ছন্দহীন স্রোতে গা ভাসিয়ে কূলে ফিরে আসাই কুত্রাপির প্রস্তাবনা। যেন ছন্দহীনতায় গা ভাসিয়ে আবার শৃঙ্খলায় ফিরে আসা। ছন্দের নিয়মহীনতার এই নবতর নিয়মকেই কুত্রাপি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এই ছন্দের প্রবর্তক, দ্রাবিড় সৈকত। কাব্য দেবীর সকল আভরণ অক্ষুণ্ণ রেখেও বার্তা বা দৃশ্যের অবতারণা যে প্রস্তাবিত নয় থেকে এগারো চরণে সম্ভব কুত্রাপি তার নিদর্শন কারণ ‘এর থেকে দীর্ঘায়িত হলে স্বাদে কিছুটা ভাটা পড়তে পারে আর কম হলে মনে হতে পারে হাওয়াই মিঠাই’। কদাচিৎ কুত্রাপি গ্রন্থটি যদি কুত্রাপি ছন্দের ভিত্তিস্থাপনের সূচনা হিসেবে ধরে নিই তাহলে বিকস্বর কুত্রাপি গ্রন্থটি হচ্ছে তার সার্বিক বিকাশ।
ছন্দে অছন্দে ক্ষয়ে যেয়ে বয়ে যেয়ে এখানে শুধু কবিতাই নির্মিত হয়েছে জীবনের আকণ্ঠ পেয়ালাজুড়ে। “কিছু বুঝি না/খুঁজি না কোন মন্ত্র বাঁচিবার/আছি কার দিকে ফিকে হয়ে আসা ভাবনায়/যাব না’য়, দরিয়া এমন কই/হইচই অথবা নৈঃসঙ্গের রঙে ডুবে যাই” অথবা “উদ্ভট আত্মার কাছে বসে থাকো বালি গায়ে” এসব চরণে কথিত ছন্দের নিয়ম না মানলেও চলে এসেছে স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দের প্রণোদনা এবং রয়েছে কবিতার নির্দিষ্ট গঠনরূপ যা কবি’র বহুল নিরীক্ষার ফসল।
আটপৌরে নির্যাস থেকে বিস্ময় ও বৈচিত্র্য নির্মাণেই কুত্রাপির সার্থকতা। নির্দিষ্ট কোন ছকে না থেকেও ভূলোক দ্যুলোক পরিভ্রমণের মানচিত্র হাতে এমন নান্দনিকতার অভিজ্ঞতা আর কোথায় সম্ভব! খানিকটা বিচ্ছিন্নতার মাঝেও ঠাই পেয়েছে সামগ্রিক গভীরতা; আঁকা হয়ে যাচ্ছে সকল আর্তনাদ, উত্তেজনা, কর্তাদের ঘরে ঠাই না পাওয়া অহর্নিশ কিলবিলে ছন্দের ধার। কুত্রাপি তাই হয়ে যায় সকলের। সকল সময়ের… ছন্দ আর ছন্দহীনের। শ্রাবণের কোন একদিনে একান্ত কুঠুরি খুলে দিলে যেভাবে নিমগ্ন জোছনাও জেনে যায় যমজ উড়াল, কুত্রাপি তার পাঠককে নিয়ে যায় সেই চন্দ্র পথের চোরা স্রোতে; বলে, “সময়ের স্রোত খুলে একবার তুলে দেবো বৃষ্টির জল ব্যবধান”।
রিভিউ লিখেছেন সূর্য্যমুখী